ইতিহাসের যবনিকাপাত, মানুষ মরনশীল। মৃত্যুকে অতিক্রম করার ক্ষমতা মানুষের নেই।
নশ্বর দেহ পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়, মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে। অধ্যক্ষ আফজল খান ও আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মগুণে। ভালো-মন্দ আপেক্ষিক বিষয়, পছন্দ-অপছন্দ রাজনীতির স্বাভাবিক বিষয়। আফজল খানও হয়তো ভালো-মন্দ, পছন্দ-অপছন্দের উর্দ্ধে ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে তৃণমূল থেকে উঠে আসা নিবেদিত প্রাণ একজন রাজনৈতিক কর্মী। আফজল খান কুমিল্লার ইতিহাসের অংশ।তাঁকে বাদ দিয়ে কুমিল্লার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের জন্মের সাথে জড়িয়ে আছে তাঁর চাচা মোসাদ্দেক আলী খানের নাম। আফজল খান যখন ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত হন তখন কুমিল্লায় ছাত্র ইউনিয়নের রমরমা অবস্থা অপর দিকে এনএসএফ এর অত্যাচার। আফজল খান, সৈয়দ রেজাউর রহমান, রফিকুল ইসলাম মিয়া ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। সাথে ছিলেন আবদুর রউফ, মফিজুর রহমান বাবলু। তিনি নেতা মানতেন মরহুম হাবিবউল্ল্যা চৌধুরী কে। প্রথম দিকে কলেজ অধ্যক্ষ সফিকুর রহমানের সহানুভূতি ও ছিল। প্রত্যেক পাড়ায়-মহল্লায়, ইউনিয়নে তথা পুরো কুমিল্লা জুড়ে সংগঠনকে সংগঠিত করলেন তিনি। সংগঠন করতে যেয়ে বঙ্গবন্ধুর সান্যিধে আসেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন হন। বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় আসলেই বলতেন আমার আফজল কোথায়? একজন আফজল খান কি হতে পারতেন কিংবা কি হয়েছেন সেটি অন্য আলোচনা। আজকে আমরা সেই আলোচনায় নাই বা গেলাম। কিন্তু তিনি যা করেছেন সেটিই বা এক জীবনে কয় জন মানুষ পারে?মুক্তিযুদ্ধে তার রয়েছে এক গৌরবজ্জল অধ্যায়।ছয়দফা আন্দোলন,৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে তাঁর ভূমিকা অনন্য।একাধারে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ভিপি, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক, জেলা চৌদ্দ দলের সম্বনয়ক, কুমিল্লা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, রেড ক্রিসেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান কোনটা ফেলে কোনটা বলি! অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের মাধ্যমে যে আলোর ঝর্ণাধারা ছড়িয়ে দিয়েছেন কুমিল্লা জুড়ে তা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনাদিকাল।
৭৫ পরবর্তী দুঃসময়ে বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের সময় কুমিল্লায় আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার মূল কান্ডারী আফজল খান। ১৯৮৯ সনের ১৫ই আগস্ট কুমিল্লায় ফ্রিডম পার্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আফজল খানের সাহসী নেতৃত্বে সেদিন আমরা যারা উপস্থিত ছিলাম তাদের লড়াইয়ের স্পৃহা বাড়িয়ে দিয়েছিল শত গুণ। সংগঠন করতে যেয়ে বার বার নির্যাতিত হয়েছেন আফজল খান। খুনি ডালিমের অত্যাচারের চিহ্ন জীবনের শেষ দিন পযর্ন্ত আফজল খান বয়ে বেড়িয়েছেন।
পারিবারিক ভাবে আমি আফজল চাচার স্নেহভাজন ছিলাম। তার কোলে চড়েছি অসংখ্যবার। আমার বাবা এবং আফজল চাচা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তারা একসাথে জেলা আওয়ামী লীগের কার্য নির্বাহী কমিটিতে ছিলেন। সমবায় আন্দোলনে ছিলেন হরিহর আত্মা। আমার ছোটবেলায় আফজল চাচাকে প্রায় দেখতাম আমাদের বাসায়। কিন্তু আমি যখন ভিক্টোরিয়া কলেজ উচ্চ মাধ্যমিক শাখায় অধ্যায়ন কালে বাহার ভাই সমর্থিত ছাত্র লীগের প্যানেল থেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করি তখন তিনি মনে কষ্ট পেয়েছিলেন বৈকি! কিন্তু কখনো তার আচরণে কিংবা কথায় আমাকে আঘাত দিয়ে কথা বলেননি। ২০০৮ এর সংসদ নির্বাচনের সময় আমি সদর আসনে আওয়মালীগের প্রেস উইংএর মূল দায়িত্বে ছিলাম।তিনি খুব খুশী হয়েছিলেন।দেখা হলেই বলতেন সেকথা।আমার বাবার মৃত্যুর পরেও যখনি উনার সাথে যেখানেই দেখা হোক স্বস্নেহে আমার খোঁজ নিয়েছেন, পরিবারের খবর নিয়েছেন, এক টেবিলে বসিয়ে ভাত খাইয়েছেন। কবে উনাকে আমার বাসায় দাওয়াত দিবো জানতে চেয়েছেন। আজকে চোখ ভিজে যাচ্ছে সে দাওয়াত টুকু আর দেওয়া হয়নি। আমার মায়ের হাতের সিদল শুটকি তার অসম্ভব প্রিয় ছিলো আমাকে প্রায় সে কথা বলতেন। আজকে সবই অতীত হয়ে গেলো।
কোনো মানুষই ভুল ত্রুটির উর্দ্ধে নয়। আফজল খান ও একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কোথায় ভুল করেছেন কিংবা কোথায় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন তা ইতিহাস একদিন নির্ধারণ করবে। তবে তাকে ব্যবহার করে অনেকেই নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। আফজল খান হয়তো এমপি,মন্ত্রী হতে পারেননি। তথাপিও দেশ জুড়ে আওয়ামী লীগের কর্মীদের কাছে আফজল খান একটি ব্র্যান্ড।অনেক মন্ত্রী এমপির নাম নিজ এলাকার বাইরে দলের নেতাকর্মীরাও জানেননা।কিন্তু আওয়ামলীগের আফজল খান বললে পুরো দেশবাসী একনামে চিনেন।এটি অনেক বড় পাওনা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিন প্রিয় আফজল চাচার জানা অজানা ত্রুটি গুলোকে ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন এই প্রার্থনা করি।শোকসন্তপ্ত পরিবারকে এই শোক বইবার সামর্থ্য দিন।আফজল খান বেঁচে থাকবেন আওয়ামীলীগের আফজল হয়ে।
আহসানুল কবীর, ইতিহাসবিদ, সাবেক ছাত্রনেতা ।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply