পলাশ রহমান: ইতালির যর্জা মেলোনি সরকার আগামী ৩ বছরে ৪ লাখ ৫২ হাজার শ্রমিক আমদানির ঘোষনা দিয়েছে। ২০২৩ সালে ১ লাখ ৩৬ হাজার, ২০২৪ সালে ১ লাখ ৫১ হাজার এবং ২০২৫ সালে ১ লাখ ৬৫ হাজার শ্রমিক আমদানি করা হবে।
এ বিষয়ক সরকারি গেজেটে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ১ লাখ ৩৬ হাজার শ্রমিক আমদানির জন্যে ডিসেম্বরের ২, ৪ এবং ৮ তারিখ থেকে আবেদন জমা নেয়া শুরু হবে। আবেদন ফর্ম ইতমধ্যে মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে উন্মুক্ত করা হয়েছে।
২ ডিসেম্বর স্থায়ী শ্রমিক বা নন সিজন্যাল শ্রমিকের জন্য আবেদন গ্রহণ করা হবে। এই ক্যাটাগরিতে ৫২ হাজার শ্রমিককে ভিসা দেয়া হবে।
৪ ডিসেম্বর গৃহকাজের জন্যে আবেদন গ্রহণ করা হবে। এতে বেবি এবং বয়স্ক সিটিংসহ প্রায় ১০ হাজার ভিসা দেয়া হবে।
৮ ডিসেম্বর তারিখে সিজন্যাল ক্যাটাগরির জন্য আবেদন গ্রহণ করা হবে এবং ৮২ হাজার ভিসা দেয়া হবে। আবেদন গ্রহণ শুরুর দিনকে ইতালিতে ‘ক্লিক ডে’ বলা হয়। সুতরাং ২০২৩ সালের ক্লিক ডে হলো- ২, ৪ এবং ৮ ডিসেম্বর।
এছাড়া সরকারি ঘোষনা অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারী মাসে ২০২৪ সালের ১ লাখ ৫১ হাজার শ্রমিকের জন্য আবেদন গ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ ২০২৪ সালের ক্লিক ডে- ৫,৭ এবং ১২ ফেব্রুয়ারী।
কারা আবেদন করতে পারবেন? কোনো শ্রমিক সরাসরি আবেদন করতে পারবেন না। শ্রমিকের পক্ষে নিয়োগদাতা অনলাইনে নির্দিষ্ট ফর্ম পুরণ করে আবেদন করবেন। এ ক্ষেত্রে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিগত দিনের ট্যাক্স প্রদান নিয়মিত এবং গৃহ মালিকদের নির্দিষ্ট অংকের বার্ষিক আয় থাকতে হবে। নিজের বাড়ি বা ভাড়া বাড়ির কন্ট্রাক থাকতে হবে। ইতালিয় ডকুমেন্ট ‘কার্তা দি সোজর্ণ’ধারী অভিবাসীরাও শ্রমিক আমদানি করতে পারবেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা গৃহ কাজের জন্যে। নিয়োগপ্রাপ্ত হতে কী যোগ্যতা লাগবে? বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। অন্তত ২ বছর মেয়াদের পাসপোর্ট থাকতে হবে। যারা দক্ষ শ্রমিক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন তাদের কর্মদক্ষতার প্রমাণাদি থাকতে হবে। শিক্ষাগত কোনো সনদ প্রয়োজন হবে না।
কত খরচ হবে? আবেদন করতে শ্রমিকের খরচ হওয়ার সুযোগ নেই। আবেদনকারী বা নিয়োগদাতার খরচ হয় ১৬ ইউরো। অর্থাৎ আবেদনের সঙ্গে ১৬ ইউরো মূল্যের একটি ডাকটিকেট (মার্কা দা বোল্লো্) সংযোগ করতে হয়। এর বাইরে আবেদন ফর্ম পুরণ করতে যদি কোনো হেল্প ডেক্সের সহযোগীতা নেয়া হয়, সেখানে এক থেকে দেড়শ ইউরো খরচ হতে পারে। কিন্তু একজন শ্রমিক যেহেতু সরাসরি আবেদন করতে পারেন না বা বাংলাদেশে বসে ইতালিয় নিয়োগদাতা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব প্রায়, মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায় একজন ‘মধ্যস্বত্বভোগী’। মূলত শ্রমিকের কাছ থেকে সে’ই মোটা অংকের অর্থ নেয়। যা ৬ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত গড়ায়। কত টাকা আয় করা যাবে? যারা দক্ষ শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পাবেন, তারা নিয়োগের স্তর বুঝে পারিশ্রমিক পাবেন, যা মাসিক ১৫শ থেকে ২৫শ ইউরো পর্যন্ত হতে পারে। যারা অদক্ষ বা মৌসুমী শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পাবেন, তারা মাসে সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয় করতে পারবেন। যদি নিয়োগদাতার সঙ্গে থাকা-খাওয়ার চুক্তি থাকে তবে আয়ের বড় অংশ সঞ্চয় করা যায়, অন্যথায় এতে বড় একটা অংশ বেরিয়ে যায়। অর্থাৎ একজন মৌসুমী শ্রমিক যদি ইতালি আসতে ৬ লাখ টাকা খরচ করনে, তা কোনো ভাবেই এক সিজনে (৯ মাস) সঞ্চয় করা সম্ভব হয় না।
কতদিন ইতালিতে থাকা ও কাজ করা যাবে? যারা নন সিজন্যার শ্রমিক হিসেবে আসেন তাদের ইতালিয় ডকুমেন্ট (পেরমেচ্ছো দি সোজর্ণ) নবায়ন করা হয় সাধারণত ২ বছর অন্তর। যারা অদক্ষ বা সিজন্যাল ভিসায় আসবেন তারা সর্বোচ্চ ৯ মাসের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। ৯ মাস পর অবশ্যই নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। বাংলাদেশের জন্যে কী কোটা আছে? অতীতে বাংলাদেশের জন্যে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজারের কোটা বেধে দেয়া হলেও এখন কোনো কোটা নেই। মেলোনি সরকার দেশ ভিত্তিক কোটা পদ্ধুতি উঠিয়ে দিয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশসহ কোনো দেশের জন্যেই নির্দিষ্ট কোনো কোটা নেই।
আবেদনের শেষ তারিখ কবে? অতীতে আবেদন গ্রহণের শেষ তারিখ উল্লেখ থাকলেও এবার সরকারি গেজেটে কোনো তরিখ উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ ২০২৩ সালের মোট ১ লাখ ৩৬ হাজারের কোটা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আবেদন গ্রহণ চলবে। তবে সাধারণত ক্লিক ডে’র প্রথম ১০ মিনিটের মধ্যেই কোটা পুরণ হয়ে যায়। আবেদন করলেই কী ইতালিতে যাওয়া যাবে? প্রতিটা আবেদন যাচাই-বাছাই করা হবে। আবেদনের সকল শর্ত ঠিক থাকলে এবং কোটার আওতায় থাকলে ২ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ‘নূল্যা-ওস্তা’ (ভিসার অনুমোদনপত্র) বা এনওসি দেয়া হবে নিয়োগদাতার কাছে। নিয়োগদাতা সেটা পাঠাবেন শ্রমিকের কাছে। শ্রমিক সেটা জমা দিয়ে ঢাকার ইতালিয় দূতাবাস বা ভিসা এজেন্সিতে ভিসার জন্যে আবেদন করবেন। সাধারণত নূল্যা-ওস্তায় কোনো অসঙ্গতি না থাকলে ভিসা রিফিউজ করা হয় না। অতীতে দালাল চক্র নকল নূল্যা-ওস্তা দিয়ে মানুষের সাথে প্রতারণা করার খবর ইতালিয় মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।
সিজন্যাল এবং নন সিজন্যাল ভিসার পার্থক্য কী? সিজন্যাল ভিসা বা স্পন্সর হলো মৌসুমি শ্রমিকদের জন্যে। গৃষ্মের সময়ে ইতালির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিজন্যাল শ্রমিক দরকার হয়। যেমন, পর্যটক নির্ভর ব্যবসা, কৃষি কাজ, ইত্যাদী। এসব কাজের জন্যে প্রতি বছর ইতালিতে ৬ থেকে ৯ মাসের জন্যে সিজন্যাল শ্রমিক আমদানি করা হয়। এই ক্যাটাগরির ভিসাকে স্তাজোনালে বা সিজন্যাল ভিসা বলে। বাংলাদেশে অনেকে এটাকে ‘কৃষি ভিসা’ নামে জানে। ৬ থেকে ৯ মাসের সিজন্যাল ভিসায় যারা ইতালিতে আসেন, ভিসার মেয়াদ শেষ হলে বাধ্যতামূলক তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হয়। না গেলে অবৈধ অভিবাসী হিসাবে গণ্য হয় এবং দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হয়। ইতালিতে অবৈধ অভিবাসীরা রেগলার কোনো চাকরি পায় না। পুলিশের চোখ এড়িয়ে হকারি করে জীবন নির্বাহ করতে হয়। নন সিজন্যাল ভিসা বা ‘সুবোরদিনাতো’ হলো স্থায়ী শ্রমিকের ভিসা। এই ক্যাটাগরিতে একজন শ্রমিক ইচ্ছা করলে সারাজীবন ইতালিতে থাকতে পারবে, যদি বিশেষ কোনো অপরাধে না জড়ায়। কল-কারখানা, হোটেল-রেষ্ট্ররেন্ট, গৃহ শ্রমিক, নার্স, বেবি সিটার, ইলেট্রিশিয়ান, বাস-ট্রাক ড্রাইভার, মেকানিক, খাদ্য প্রস্তুত এবং সরবরাহ, ভবর নির্মান, জাহাজ নির্মান, টেলিকমিউনিকেশনসহ বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকদের জন্যে এই ভিসা দেয়া হয়। তবে বাংলাদেশি ড্রাইভিং লাইসেন্স ইতালিতে অনুমোদিত না হওয়ায়, ড্রাইভার পদে বাংলাদেশ থেকে নিয়োগ পাওয়া যাবে না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশের ড্রাইভংলাইন্স ইতালিতে অনুমোদিত, ওইসব দেশের প্রবাসীরা আবেদন করতে পারবেন। ইতালি এখন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্যও অনুকুল একটা দেশ।
২০২২-২৩ সালে ইতালির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা-পড়া করতে বাংলাদেশি ৬ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে ভিসা দেয়া হয়েছে। এর জন্যে ইতালিয় বিশ্ববিদ্যায়লগুলোয় যোগাযোগ করতে হবে। সহজ স্কলারশিপসহ কম খরচে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইতালি এখন এশিয়ানদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় দেশ। উল্লেখ্য, ইতালিতে সাধারণ বাংলাদেশি শ্রমিকদের বেশ সুনাম আছে। নিয়োগদাতারা বাংলাদেশি শ্রমিকদের পছন্দ করেন। ২০২২-২৩ সালের এ পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিককে ভিসা দেয়া হয়েছে।
Leave a Reply