বুধবার, ০৭ জুন ২০২৩, ০৭:৫৯ পূর্বাহ্ন

ইসলামে সূফী ও সূফীবাদ

জাহাঙ্গীর আলম জাবির
  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ৪ জুন, ২০২১
  • ৪২৯ বার
ফাইল ছবি

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির।। মহান আল্লাহ প্রদত্ত, তাঁর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থার নাম ইসলাম। আল্লাহপাক বলেন, ইন্নাদ্দীনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৯) অর্থাৎ ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম হলো ইসলাম।’ ইসলাম প্রেমের ধর্ম, শান্তি ও মানবতার ধর্ম; উদারতা, সহনশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং অসাম্প্রদায়িকতা ধর্ম। এতে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ ও বিধিবদ্ধ এক জীবন ব্যবস্থা। সব মানুষের মুক্তি, কল্যাণ ও সফলতার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছুর আয়োজন রয়েছে এই মহান ধর্ম ইসলামে। জীবনের সব কাজে আল্লাহর আনুগত্যই হলো ইসলাম। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তা কার্যে পরিণত করে দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় তথা সব কাজই আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে সম্পাদন করেছেন। তাকে যিনি যত বেশি অনুসরণ করতে পারবেন, তিনি তত ভালো মানুষ হিসেবে পরিগণিত হবেন।

নামাজ-রোজা ও যাবতীয় কর্মের ভেতর দিয়ে আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণই ইসলাম। মনীষী থমাস কারলাইল (১৭৯৫-১৮৮১ খ্রি.) বলেন,‘Islam means in its way denial of self, annihilation of self. This is yet the highest wisdom that heven has reveald to our earth.’ ইসলাম সম্পূর্ণ নতুন ধর্মমত নয়। অন্যান্য নবী যেসব সত্য প্রচার করেছেন ইসলামে সেসবই আছে। তদুপরি কতগুলো আন্তর্জাতিক বিধি -ব্যবস্থাও তাতে রয়েছে। সুতরাং ইসলাম হচ্ছে সর্বধর্মের সমন্বয়। ভিন্ন ধর্মের লোক ইসলামে প্রবেশ করলে তিনি পূর্ববর্তী ধর্মের সত্যগুলো তো পানই, অতিরিক্ত কতগুলো সুযোগ-সুবিধাও পেয়ে থাকেন। এটি ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সামাজিক সাম্য, মৈত্রী, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি হলো ইসলামের বৈশিষ্ট্য। এসবই মানুষকে ইসলামের দিকে আকর্ষণ করে থাকে। পবিত্র ধর্ম ইসলামের দুটি প্রধান অধ্যায় রয়েছে। এর একটি অন্তরঙ্গ ও অপরটি বহিরঙ্গ এবং একই সঙ্গে একটি ব্যতীত অপরটি অসম্পূর্ণ। তাসাউফ তথা সুফিবাদ ইসলামের অন্তরঙ্গ এবং শরিয়তের বহিরঙ্গ হিসেবে সাব্যস্ত। সুফিবাদ শরিয়তবিরোধী নয়। ইসলামের অনুশাসন অনুযায়ী সব কাজ সম্পাদন করতে হবে বটে; কিন্তু যে মৌলিক কারণে এই অনুশাসনের সৃষ্টি- তা চিন্তা করে তদনুসারে মনোবৃত্তি ও কার্য সম্পাদন উভয়কেই নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। সুফি-সাধকরা কাজে ও চিন্তায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ঐশী ইচ্ছার ওপর সমর্পণ করেন এবং প্রতিটি যুগের ও সব দেশের প্রত্যাদিষ্ট বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করেন। সুফিগণ জাতি, স্থান ও কাল নির্বিশেষে সবাইকে আলিঙ্গন করেন এবং সবাইকে সমান ও সমমর্যাদার জ্ঞান করেন। কেননা জাতিবিরোধ হলো ইসলামের অনুশাসন বিরুদ্ধ বিষয়। সুফিদের প্রভু সব জগতের প্রভু। তিনি কোনো বিশেষ জাতির প্রতিপালক নন, তিনি সব আলমের প্রতিপালক। সারাবিশ্বের একমাত্র প্রভু তিনি এবং তারই জন্য সমস্ত মহিমা, শক্তি ও মাহাত্ম্য। সব সৃষ্টজীব একই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। অন্য কোনো ধর্ম এই বিশ্বজনীন স্বপ্ন কার্যে পরিণত করতে সমর্থ হয়নি। প্রকৃতি একত্বের পরিচায়ক। উদ্ভিদজগৎ, প্রাণিজগৎ আর জড়জগৎ একই নিয়মের অধীন। গ্রহ, উপগ্রহ, নদী, পর্বত পরস্পর বিভিন্ন হলেও একই বিধানের অনুবর্তী। সৃষ্টবস্তুর বহুত্বের মধ্যে একত্ব সর্বদা বিরাজমান। সুফিবাদ এই বিশ্বজোড়া একত্বের পরিপোষক। প্রতিটি মানুষের মধ্যে রুহ (আত্মা) এবং নফ্স (প্রবৃত্তি) রয়েছে। এ দুটি পার্থিব পরীক্ষার উপাদান। পরস্পর যুদ্ধ করাই এদের প্রকৃতি। আত্মা চায় প্রবৃত্তির ওপর সওয়ার হতে আর প্রবৃত্তি আত্মার ওপর প্রভুত্বের প্রয়াস চালায়। আত্মার আগমন পরমাত্মার কাছ থেকে আর সে পরিচালিত হয় তারই আদেশে। আত্মা মানুষকে সৎপথে চালিত করে প্রভুর নৈকট্য লাভ করার জন্য সর্বদা উদগ্রীব থাকে। অপরদিকে প্রবৃত্তি আত্মার আবেদন উপেক্ষা করে মানুষকে অভিশপ্ত শয়তানের ধোঁকায় ফেলতে সদা প্রস্তুত থাকে এবং শয়তানও নফসের সঙ্গে সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করে রুহকে বিভ্রান্ত করতে সচেষ্ট থাকে। আত্মা ও প্রবৃত্তির এই দ্বন্দ্ব চিরন্তন এবং অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। আর মানুষকে আমৃত্যু এই দ্বন্দ্বের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে হয়।

সুফিবাদ প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মানুষকে মুক্ত করে আত্মার সজীবতা আনয়নপূর্বক পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সুফিদের আত্মা হয় নির্মল, পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ আর তাদের নফ্স হয় নফসে মুতমাইন্নাহ (The nafs at peace)| বাংলাদেশে প্রকৃত – সুফিবাদ প্রবেশ করে সেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালের (১১৭৯-১২০৪ খ্রি.) অবসানের সঙ্গে সঙ্গে এবং ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের (১২০৪ খ্রি.) মাধ্যমে। বঙ্গ বিজয়ের পর আরব, পারস্য ও তুরস্ক থেকে দলে দলে মুসলিম দরবেশ ও সুফিগণ এ দেশে আগমন করেন এবং ইসলামের বাণী, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও শান্তির কথা প্রচার করতে থাকেন। তাদের চারিত্রিক গুণ, খোদাপ্রেম ও প্রচারিত বাণীর বদৌলতে অজস্র অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করতে থাকেন। এ দেশে ইসলাম তরবারি দিয়ে আসেনি; বরং সুফি-দরবেশদের উদার, নৈতিক ও প্রেমময় বাণীর মাধ্যমেই এসেছে, যার উজ্জ্বল নিদর্শন এই বাংলায় আগত সুফিগণের নিরলস প্রচার ও এতদঞ্চলের গণমানসে তার সহৃদয় স্বীকৃতি। আমাদের দেশে যে পীর-দরবেশগণ ইসলাম প্রচার করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন যুগে আগমন করেছেন, তাদের প্রত্যেকের জীবনে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সঙ্গে সময়োক্ত জীবনের পরাকাষ্ঠা ছিল সংযুক্ত। বিক্রমপুরের বাবা আদম শহিদ (খ্রি. ১১ শতক), মোমেনশাহির মদনপুরের শাহ সুলতান রুমি (আগমন ১০৫৩ খ্রি.) বা সিলেটের হজরত শাহজালালের (১১৯৬-১৩৪৬ খ্রি.) জীবনে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে প্রয়োজনবোধে সংগ্রামশীলতারও সমাবেশ ছিল। এ দেশের যে কোনো ধর্মপ্রচারকের জীবনীতে দেখা যায়, এরা কেউ শুধু ধর্মপ্রচারক ছিলেন না বা শুধু মুজাহিদ ছিলেন না; অতি উচ্চস্তরের দরবেশও ছিলেন এবং ব্যক্তি-মানস হিসেবে তারা ছিলেন সমসাময়িক সব মানুষের জন্য অনুকরণীয় আদর্শস্বরূপ। তাদের চরিত্রে, নৈতিকতায় আর মূল্যবোধে মানবিকতা আর অসাম্প্রদায়িকতার প্রোজ্জ্বল নিদর্শন বিদ্যমান ছিল।

আজকের বাংলাদেশে সুফিবাদের উদারনৈতিক ও মানবতাবাদী আদর্শকে মেনে চললে সমাজদেহে প্রত্যাশিত শান্তি ও নিরাপত্তার ফল্গুধারা প্রবাহমান থাকবে- এ কথা বলা যায়। কারণ,নবী- রাসুল,সাহাবা,তাবেঈন,তাবে তাবেঈন, আউলিয়ায়ে কেরাম হয়ে আসা ধর্ম তথা পথ ও মতই প্রকৃত ইসলাম। এর বাইরে যত পথ ও মত সবই ভ্রান্ত এবং ঈমান ধ্বংসে লিপ্ত।

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির

লেখক,ধর্মীয় টিভি উপস্থাপক,

গবেষক ও চেয়ারম্যান – গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা। 01718-228446

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2023 DeshPriyo News
Designed By SSD Networks Limited
error: Content is protected !!