বৃহস্পতিবার, ০১ জুন ২০২৩, ১১:৪১ পূর্বাহ্ন

উপহারের ঘরেও ফাটল!

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১০ জুলাই, ২০২১
  • ৬৬৬ বার
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

ছোটবেলায় একটা গল্প শুনেছিলাম। এক শীতের রাতে একদল শিয়াল জঙ্গলে একত্র হয়ে তাদের স্বভাবধর্ম অনুযায়ী হুয়াক্কা হু করছিল। রাজা তা শুনে ভাবলেন শিয়ালেরা কাঁদছে। তিনি তার মন্ত্রী-আমলাদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, শিয়ালরা কাঁদছে কেন? দুর্নীতিবাজ আমলারা ভাবল, এই তো সুযোগ দু’পয়সা কামাবার। তারা রাজাকে জানাল, শিয়ালগুলো দারুণ শীতে তাদের কষ্টের কথা রাজাকে জানানোর জন্য কাঁদছে। রাজা বললেন, আহা বেচারারা। যত টাকা লাগে কোষাগার থেকে নিয়ে শিয়ালদের জন্য কম্বল কিনে দাও। আনন্দে গদগদ হয়ে আমলারা টাকা ভাগ করে নিজেদের পকেটে ঢুকিয়ে ঘরে ফিরে গেল।

কিছুদিন পর শিয়ালেরা আবার জঙ্গলে জড়ো হয়ে স্বভাবসিদ্ধ হুয়াক্কা হু শুরু করল। রাজা বিস্মিত হয়ে আমলাদের জিজ্ঞাসা করলেন, শিয়ালদের এই সেদিন কম্বল দেওয়া হলো, তারা কাঁদছে কেন? আমলারা জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। তারা বলল, হুজুর ওরা কাঁদছে না। এই দারুণ শীতে কম্বল পেয়ে ওরা রাজার গুণগান গাইছে। তবে এই শীতে তারা শিকার করতে পারছে না। সে জন্য ক্ষুধায় কাতর হয়ে ওদের কেউ কেউ কাঁদছে। রাজা আবার ক্ষুধার্ত শিয়ালদের খাবার কেনার জন্য বিশাল অঙ্কের টাকা দিলেন। আমলারা খুশি হয়ে যথারীতি তা পকেটে পুরল।

এই গল্পটি আপনারা সবাই জানেন। তবু লিখলাম ঢাকার কাগজে শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুত মুজিববর্ষে বাংলার ৯ লাখ গৃহহারা পরিবারকে ঘর দেওয়া প্রকল্পের স্থানবিশেষের পরিণতি দেখে। আমার ধারণা, ফজলুল হক ও শেখ মুজিবের পর শেখ হাসিনা বাংলার মানুষকে যতটা ভালোবেসেছেন, এতটা আর কেউ ভালোবাসেননি। প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতায় বসার পর শেখ হাসিনা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পুনর্বাসনসহ যত উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, তার কোনো তুলনা নেই। তা সত্ত্বেও তার পরিশ্রমের সব ফসল লুটে খাচ্ছেন একদল আমলা এবং তার দলের দুর্নীতিবাজ একশ্রেণির নেতাকর্মী। তারা ক্ষমতার বিভিন্ন পদে বসে দু’হাতে যেমন লুটপাট করছেন, তেমনি প্রধামন্ত্রীকে শিয়ালের কান্নার অর্থ শোনাচ্ছেন।

এরা সবাই যে চোর-বাটপাড় তা নয়; তাদের মধ্যে ভালো মানুষেরাও আছেন। তবে সংখ্যায় কম। অসাধুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং বলশালী। তাদের ভয়ে সংখ্যায় কম ভালো মানুষেরা কোথাও কোনো কথা বলতে পারেন না। শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর কোনো রাজনৈতিক ভুলত্রুটি করেননি, সে কথা বলি না; কিন্তু শহুরে মধ্যবিত্তের উন্নয়ন, গ্রামের স্বল্পবিত্ত ও নিঃস্ব মানুষের উন্নয়নের জন্য যত প্রকল্প তৈরি করেছেন এবং টাকা ঢেলেছেন, তার কোনো তুলনা নেই। এই টাকা যদি তার একশ্রেণির আমলা ও দলের লোক মিলে চুরি না করত, তাহলে দেশের গ্রামীণ চেহারা এখন যতটা পাল্টেছে, তারচেয়ে অনেক বেশি পাল্টে যেত। চাঁদপুর ও মেহেন্দীগঞ্জের উর্বর বিশাল এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হতো না। উত্তরবঙ্গে খরার আভাসে কৃষকদের এখনও আতঙ্কে দিন কাটাতে হতো না।

অবশ্য শেখ হাসিনা উত্তরবঙ্গের মঙ্গা ঠেকিয়েছেন। দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গের বন্যা ঠেকিয়েছেন। দেশে কর্মহীন, বেকার যুবকের সংখ্যা কমিয়েছেন। মানুষের দারিদ্র্য দূর করেছেন। সম্ভবত, তিনি তার এবারের তিন দফা শাসনামলেই বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করতে পারতেন, যদি ভয়াবহ করোনা মহামারির সঙ্গে তার প্রশাসন ও দলের একশ্রেণির মানুষ উন্মত্ত লোভী ও দুর্নীতিবাজ হয়ে না উঠত। শেখ হাসিনা এই বিশাল দুর্বৃত্তশ্রেণির লাগাম টানবেন কীভাবে?

ঢাকার একটি দৈনিকের ২১ জানুয়ারির (২০২১) সংখ্যা থেকে একটি খবরের উদ্ৃব্দতি দিচ্ছি। ‘সারাদেশে ভূমি ও গৃহহীন আট লাখ ৮৫ হাজার ৬৬২ পরিবারকে বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছে সরকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষে এটিই হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া বিশেষ উপহার। ২০২০ সালের ৭ মার্চ শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, দেশের একটি মানুষও গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না। মুজিববর্ষে প্রতিটি গৃহহীন-ভূমিহীন পরিবারই পাচ্ছে দুর্যোগ সহনীয় সেমিপাকা ঘর আর দুই শতাংশ জমির মালিকানা। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দুই শতাংশ জমির মালিকানাসহ রঙিন সুদৃশ্য টিনশেডের সেমিপাকা ঘর পাবেন গৃহহীন ও ভূমিহীনরা। সারাদেশে গৃহহীনদের জন্য গৃহ নির্মাণের এই মহাযজ্ঞ প্রতিনিয়ত মনিটরিং করছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’

এই খবর পাঠের পর রূপগঞ্জ এবং কক্সবাজারের চকোরিয়ায় ভূমিহীনদের জন্য তৈরি সুদৃশ্য ঘরগুলো দেখে আমার মনেও লোভ জেগেছিল- আহা, এমন একটি বাড়ি যদি আমি পেতাম! তারপরই নিদারুণ স্বপ্নভঙ্গ। এই জুলাই মাসের শুরুতে ঢাকার একটি দৈনিকে খবরের হেডিং দেখলাম, ‘আড়াই ঘণ্টার বৃষ্টিতেই ভেঙে পড়ল প্রধামন্ত্রীর উপহারের ঘর’। আরেকটি দৈনিকের খবরের হেডিং ছিল ‘প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে দুমাসেই ফাটল’। প্রত্যেকটি খবরে ‘প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর’ কথাটি ব্যবহূত হওয়ায় পুরো খবরটি পাঠ করলাম। ‘পুরো ৫০০ বর্গফুটের প্রতিটি বাড়ির প্রতিটি ঘরেই থাকবে সোলার সিস্টেম আর বজ্রপাত নিরোধক ব্যবস্থা। প্রতিটি সেমিপাকা ঘরের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে সব ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের তালিকা করা হয়েছে।’ এই গৃহায়ন পরিকল্পনার সঙ্গে যে স্লোগানটি যুক্ত করা হয়েছে, তা হলো ‘আশ্রয়ণের অধিকার- শেখ হাসিনার উপহার’।

এই খবর পাঠের পর বুঝতে পেরেছি, অসাধু সরকারি কর্মকর্তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল গৃহহীন ও ভূমিহীনদের গৃহ ও ভূমিদান নয়, আসল উদ্দেশ্য ছিল প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করা এবং সেই খুশি করার আড়ালে নিজেদের ভাগ্য গড়ে নেওয়া। নইলে মাত্র দু’মাসেই আড়াই ঘণ্টার বৃষ্টিপাতে এই শক্তপোক্ত বাড়িঘরের অনেকগুলোই ভেঙে পড়ে কী করে? আর ভাঙছিল প্রধানমন্ত্রীর গোপালগঞ্জের মধুপুর প্রকল্পের বাড়িঘরও। ভেঙে পড়া একটি ঘরের মালিক মো. ইব্রাহিম তার পরিবার নিয়ে বাড়িটির বাইরে থাকায় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান। তিনি বলেছেন, ‘পাঁচ মাস আগে তারা বাড়িটি পেয়েছেন। এরই মধ্যে অনেক ঘরের দেয়াল ও মেঝে থেকে পলেস্তারা খসে গেছে। সামান্য বৃষ্টিতেই টিনের চালার বিভিন্ন স্থান দিয়ে পানি পড়ে। ঘরের জানালাও নড়বড়ে।’

প্রধানমন্ত্রীর উপহার নির্মাণাধীন বাড়ির দেয়াল ধসে পড়ায় ভাঙা দেয়াল চাপা পড়ে আহত হয়েছেন আশি বছরের এক বৃদ্ধা। তিনি এখন হাসপাতালে। ঘটনাটি দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার রামপুরা গ্রামের। দেওয়ানগঞ্জেই একটি পাকা বাড়ি ভেঙে পড়ায় মমতাজ বেগম ও তার যুবক নাতি গুরুতর আহত হন। তাদের দেওয়াগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়েছে।

এ রকম ঘটনা ঘটেছে বহু জায়গাতেই। অভিযোগ উঠেছে, এই গৃহ নির্মাণ প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার, অনেক জায়গায় নির্বাহী কর্মকর্তা এবং কন্ট্রাক্টর বা ঠিকাদাররা সিমেন্ট, রড, টিনের টাকা যথেচ্ছভাবে চুরি করে অত্যন্ত নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে এই ঘর নির্মাণ করায় এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। দু-এক জায়গায় হয়তো ঘর তৈরিতে অনিয়ম হয়েছে। আর সর্বত্রই ঠিকাদারদের চুরি প্রধানমন্ত্রীর উপহারের সব গৌরব ধ্বংস করতে চেয়েছে।

সিঙ্গাপুরে লিকুয়ান ‘নতুন সিঙ্গাপুর’ তৈরি করতে গিয়ে সরকারি অফিসার, স্থপতি, ঠিকাদার যারাই দুর্নীতি করবেন, তাদের প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি বেশ কয়েকজনের প্রাণদণ্ডও দিয়েছিলেন। সিঙ্গাপুর তাই বিশ্বের অন্যতম সুন্দর শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। একইভাবে তৈরি হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত রাজধানী সিউল শহর।

আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। কয়েক বছর আগে আমি দেশে গিয়ে গাড়িতে ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়ায় রওনা হয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। দেখলাম, বরিশাল-ফরিদপুর যাওয়ার জন্য গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের মতো সুপ্রশস্ত বিশাল রাস্তা তৈরি হয়েছে। মনে হয় ইউরোপে তৈরি কোনো রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে পশ্চিমা দেশের রাস্তার মতো মাইল-ইন্ডিকেটর এবং গন্তব্যস্থানের নির্দেশিকা দেওয়া। কিছুদূর যেতেই গাড়ি ঝকঝক শব্দ করে চলতে শুরু করল। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম- ব্যাপার কী? ড্রাইভার বলল, রাস্তা তো একই। যে পর্যন্ত গাড়ি ভালোভাবে চলেছে, সে পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি। আর যে ভাঙা পথ দিয়ে যাচ্ছি তা তৈরি করেছে দেশের কোম্পানি। দু’বছরও হয়নি এই রাস্তা তৈরি হয়েছে।

আমি আর কথা বাড়াইনি। কিছুকাল আগে খালেদা জিয়া হাসিনা সরকারকে সমালোচনা করতে গিয়ে নিজের মনের হিংসা প্রকাশ করেছিলেন এভাবে- ‘আমাদের নিজস্ব অর্থে তো পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে। ওই সেতুতে ওঠার আগেই সাবধান হবেন। হঠাৎ ভেঙে না পড়ে।’ যেহেতু খালেদা জিয়া কথাটা বলেছেন, সে জন্য আমরা কেউ দাম দিইনি। কিন্তু কথাটা ভেবে দেখার মতো। যমুনা বঙ্গবন্ধু সেতুতেও তো তৈরি হওয়ার বছর না ঘুরতেই ফাটল ধরেছিল। সাবেক মেয়র হানিফের নামে ঢাকায় এত বড় ফ্লাইওভার। তাও ভেঙে পড়ে নগরবাসীর প্রাণ গিয়েছিল।

ব্রিটিশ শাসকরা তাদের আমলে অবিভক্ত বঙ্গে হাওড়া ব্রিজ, ভৈরব ব্রিজ- কত ব্রিজ তৈরি করে গেছেন। শ-দেড়শ বছর চলে গেলেও সেই ব্রিজে ভাঙন ধরেনি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৈরি হাওড়া ব্রিজের পাশে তৈরি নয়নাভিরাম বিদ্যাসাগর ব্রিজ তৈরি হতে না হতেই ফাটল ধরেছিল। কোথায় যেন আমাদের উপমহাদেশীয় মানুষের চরিত্রে একটা বড় রকমের ফাটল আছে। এই ফাটল মেরামত করতে না পারলে এই উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কিন্তু এই ফাটল সারাবেন কে? বাংলাদেশে শেখ হাসিনা যতই ক্ষমতাশালী হোন, তিনি একেবারে একা। প্রশাসন, নিজের দল কোনো কিছুর ওপর তিনি নির্ভর করতে পারছেন না। তিনি একা, সম্পূর্ণ একা।

লন্ডন, ৯ জুলাই, শুক্রবার, ২০২১

সূত্র – সমকাল

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2023 DeshPriyo News
Designed By SSD Networks Limited
error: Content is protected !!