বৃহস্পতিবার, ০১ জুন ২০২৩, ১১:২৬ পূর্বাহ্ন

এই আওয়ামী লীগ কার, এই ছাত্রলীগ কার?

প্রথম আলো
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২ নভেম্বর, ২০২১
  • ৩৭৫ বার
ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রুপের হামলায় মাথায় মারাত্মক জখম নিয়ে চিকিৎসাধীন ছাত্র মাহাদি জে আকিব

অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মুসলমান ভারতে বসবাস করে। আমরা যদি বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি হিন্দুর জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলি, ভারতে ২০ কোটি মুসলমানের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এটা কিন্তু ভাবতে হবে।’ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নিশ্চয়ই জানেন, ইতিমধ্যে আসাম ও ত্রিপুরার মুসলমানরা আরেক ঝুঁকিতে পড়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার প্রতিবাদ করেছে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। কিন্তু সেখানকার সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদ কি আওয়ামী লীগ করেছে?

আমরা এই দুই নেতার বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে যে রাজনীতির চালচিত্র পাই তা খুবই উদ্বেগজনক। রানা দাশগুপ্ত বলেন, যেই আওয়ামী লীগের ভেতরে সাম্প্রদায়িক শক্তি আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়, দল কিংবা সহযোগী সংগঠনের নাম ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা চালায়, সেই আওয়ামী লীগ কখনো বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ হতে পারে না। ধর্মনিরপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ হতে পারে না। এ কারণে তিনি আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযান চালানোর দাবি জানিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বই প্রমাণ করলেন স্থানীয় সরকার সংস্থার এই নির্বাচন দলীয়ভাবে করা ঠিক হয়নি। অনেক বিশেষজ্ঞও দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন করার বিরোধিতা করেছিলেন। আসলে নির্বাচনটি এখন আর ভোটকেন্দ্রে হচ্ছে না। এ কারণেই ভোটকেন্দ্রের বাইরে মনোনয়ন নিয়ে এত কাড়াকাড়ি, মারামারি হচ্ছে। মনোনয়ন পেলেই কেল্লা ফতে। ভোট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

অন্যদিকে ওবায়দুল কাদের বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে মনোনয়নবঞ্চিত ব্যক্তিরা মনোনয়নপ্রাপ্ত নেতাদের রাজাকার, রাজাকারের ছেলে কিংবা নাতি বলে গাল দেন। এখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকেই তালাশ করে দেখতে হবে, এসব অভিযোগের পেছনে ভিত্তি আছে কি না। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। মনোনয়নবঞ্চিত ব্যক্তিরা মনোনয়ন পেলে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিরা একই অভিযোগ করতেন।

আর যদি অভিযোগ সত্য না হয়, তাহলে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে দলীয় নেতৃত্ব কী ব্যবস্থা নেয়, তাও দেশবাসী দেখতে চায়। কেবল দায় এড়ানোর কথা বলে পার পাওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগ নিজেকে সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত দল বলে দাবি করে। কিন্তু এবারে ইউপি নির্বাচনে সেই ‘শৃঙ্খলার’ নমুনা দেখলাম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ওপর হামলা, মারামারি ও কয়েকজনের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে। অবস্থা এতটাই নাজুক যে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জের অনেক স্থানে কাউকে নৌকা প্রতীক না দিয়ে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। ভোটটাও উন্মুক্ত হবে কি না, সেটা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বই প্রমাণ করলেন স্থানীয় সরকার সংস্থার এই নির্বাচন দলীয়ভাবে করা ঠিক হয়নি। অনেক বিশেষজ্ঞও দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন করার বিরোধিতা করেছিলেন। আসলে নির্বাচনটি এখন আর ভোটকেন্দ্রে হচ্ছে না। এ কারণেই ভোটকেন্দ্রের বাইরে মনোনয়ন নিয়ে এত কাড়াকাড়ি, মারামারি হচ্ছে। মনোনয়ন পেলেই কেল্লা ফতে। ভোট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
২.
ইউপি নির্বাচন নিয়ে যখন আওয়ামী লীগের লেজেগোবরে অবস্থা, তখন সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের কাণ্ডকীর্তির দিকে একবার চোখ ফেরানো যাক। রংপুরের পীরগঞ্জে জেলেপল্লিতে হামলার মূল মদদদাতা হিসেবে পুলিশ যাঁকে চিহ্নিত করেছে, তিনি আর কেউ নন রংপুর কারমাইকেল কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা সৈকত মণ্ডল। চাঁদপুরসহ অন্যান্য স্থানেও সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের নাম এসেছে।

কয়েক দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এসেছিলেন সিলেটের একটি উপজেলা পর্যায়ের নেতা। তিনি টিএসসির সামনে বন্ধুদের সঙ্গে যখন আড্ডা দিচ্ছিলেন, ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী এসে তাঁকে মারধর করেন। অপরাধ তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সমালোচনা করেন এবং সম্মেলন করে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করার দাবি জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক পোস্ট দিয়েছেন। এ পোস্ট কারও কাছে শৃঙ্খলাবিরোধী মনে হলে তিনি দলীয় ফোরামে তাঁর নামে অভিযোগ করতে পারতেন। কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মানহানির মামলাও করতে পারতেন। কিন্তু সেসব না করে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী তাঁর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।

ফেসবুকে একটা ছবিতে চোখ আটকে যাচ্ছে বারবার। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) শোয়া এক তরুণের মাথা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। ধবধবে সাদা ব্যান্ডেজের ওপর লেখা, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না।’ নিচে একটা বিপজ্জনক চিহ্নও এঁকে দেওয়া হয়েছে। চোখও সাদা ব্যান্ডেজে ঢেকে দেওয়া হয়েছে তাঁর।

এরপরের ঘটনাটি আরও মর্মান্তিক। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফেসবুকে একটা ছবিতে চোখ আটকে যাচ্ছে বারবার। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) শোয়া এক তরুণের মাথা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। ধবধবে সাদা ব্যান্ডেজের ওপর লেখা, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না।’ নিচে একটা বিপজ্জনক চিহ্নও এঁকে দেওয়া হয়েছে। চোখও সাদা ব্যান্ডেজে ঢেকে দেওয়া হয়েছে তাঁর।

সংজ্ঞাহীন এই তরুণের নাম মাহাদি জে আকিব। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। গত শনিবার সকালে কলেজের কিছু ছাত্র তাঁর ওপর হামলা করেন। মাথায় মারাত্মক জখম নিয়ে ভর্তি হন চমেক হাসপাতালে। অস্ত্রোপচারের পর তাঁর ঠাঁই হয় আইসিইউতে। এর পর থেকে নিথর পড়ে আছেন আকিব। অস্ত্রোপচারের দায়িত্বে থাকা সহকারী অধ্যাপক মাহফুজুল কাদের বলেন, আঘাত খুব বেশি ছিল। তাঁর মস্তিষ্কে এবং মাথার হাড়ে মারাত্মক আঘাত রয়েছে। মাথার হাড়ের একটা অংশ খুলে আপাতত তাঁর পেটের চামড়ার নিচে রাখা হয়েছে। কিছুটা উন্নতি হলে সেটা আবার আগের জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হবে।

শনিবার রাতে আকিবের বাবা তৌফিকুর রহমান বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা করেন। পুলিশ আকিবের ওপর হামলাকারী দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আকিবের ওপর হামলা হয় কলেজের সামনের সড়কের ফুটপাতের ওপর। পপুলার ডায়াগনস্টিকের সামনের ফুটপাতে। সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, সাত-আটজন তাঁকে ঘিরে ধরে মারছেন। মাথায় আঘাত করছেন।

চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত। এক পক্ষ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী। আরেক পক্ষ সাবেক মেয়র আ জ ম নাছিরের অনুসারী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দুই আওয়ামী লীগ নেতার ১২টি গ্রুপ আছে। ছাত্রলীগের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের মধ্যকার সংঘাতে যে কতবার ক্লাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেন অচল হয়েছে, তার হিসাব নেই। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারির পেছনে চাঁদাবাজি। করোনায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত ১৩ সেপ্টেম্বর কলেজে সশরীর শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়। দেড় মাস পর ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারিতে আবার মেডিকেল কলেজ বন্ধ হলো। এর দায় কে নেবে?

বিরোধী দলের যেকোনো সমাবেশ বা মিছিলে মারামারি হলে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জ্ঞাত-অজ্ঞাত অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করার পাশাপাশি হুকুমের আসামি করা হয় দলের দায়িত্বশীল নেতাদের। কিন্তু চট্টগ্রামে দুই নেতার আশ্রয়ে থেকে ছাত্রলীগের বিবদমান পক্ষ সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে, সেখানে রহস্যজনক কারণে হুকুমের আসামি থাকেন না। মাঝে মধ্যে দুই নেতাকে ডেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মৃদু তিরস্কার করেন।

রানা দাশগুপ্তের প্রশ্নের সূত্র ধরে আমাদেরও প্রশ্ন যে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা একে অপরকে রাজাকার বলে সম্ভাষিত করেন, যেই ছাত্রলীগের কর্মীরা ভিন্নমত প্রকাশের দায়ে নিজে সংগঠনের নেতার মাথা ফাটিয়ে দেন, যেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা চাঁদাবাজি নিয়ে বিরোধের কারণে প্রতিপক্ষের কর্মীর মাথার খুলি উড়িয়ে দেন, সেই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ আসলে কার?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2023 DeshPriyo News
Designed By SSD Networks Limited
error: Content is protected !!