বুধবার, ০৭ জুন ২০২৩, ১২:০৪ অপরাহ্ন

‘কক্সবাজারে গণধর্ষণের ঘটনায় রহস্যের শেষ নেই’

যুগান্তর
  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১
  • ২১১ বার

কক্সবাজারে স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে পর্যটক গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় রহস্যের শেষ নেই বলে মন্তব্য করেছেন কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ।

যুগান্তরকে তিনি বলেন, প্রায়ই এই নারী কক্সবাজারে অবস্থান করেন। এবারো অনেক দিন কক্সবাজার রয়েছেন। সুতরাং তাকে প্রাথমিক দৃষ্টিতে পর্যটক বলা যাবে না। কারণ এই নারী বারংবার কক্সবাজার আসার পেছনে অন্য রহস্য লুকায়িত আছে। তাছাড়া নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি নিজেকে তিনটি নামে পরিচয় দিয়েছেন। হোটেলে বলেছেন সানজিদা। অন্য জায়গায় বলেছেন সাফি। আবার আমাদের কাছে বলেছেন মায়াবি বেগম। এছাড়া আমরা এই নারীর মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বারণ করেন এবং কথা বলতে দেননি। পাশাপাশি তাদের বিয়ের তারিখ সম্পর্কে জানতে চাইলে ধর্ষণের শিকার গৃহবধূ দিচ্ছেন এক তথ্য, আবার তার স্বামী দিয়েছেন আরেক তথ্য।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, এছাড়া সব কিছু মিলিয়ে যে স্থান থেকে অপহরণের কথা ওঠেছে ওই স্থান থেকে অপহরণ কোনোভাবেই সহজ নয়। কারণ ওখানে সর্বদায় ট্যুরিস্ট পুলিশের টহল জোরদার থাকে। পাশাপাশি মানুষের প্রচুর সমাগম থাকে। সুতারাং সব কিছু মিলিয়ে এই ঘটনায় রহস্যের শেষ নেই। তবে আশা করা যাচ্ছে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে আসল ঘটনা উদ্ঘাটন হবে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঢাকার যাত্রাবাড়ীর জুরাইন এলাকায় থাকার কথা বললেও ওই দম্পতি তাদের সন্তানসহ তিন মাস ধরে কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলে থাকছিলেন। তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম ব্যবহার করতেন। ওই নারী পুলিশের কাছে বিষয়টি স্বীকার করেছেন বলেও দাবি করেছেন কর্মকর্তারা।

তারা আরও বলেন, ওই নারীর সঙ্গে ধর্ষণে অভিযুক্ত আশিকুল ইসলাম আশিকসহ কয়েক যুবকের পূর্বপরিচয় ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই নারী ও তার স্বামীর টানা তিন মাস কক্সবাজারে অবস্থানের তথ্যও পেয়েছে পুলিশ। এই দম্পতি তাদের সন্তানসহ তিন মাস ধরে কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলে অবস্থানের কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেন, ঘটনা যাই হোক না কেন প্রকৃত ঘটনা জনসম্মুখে আনতে এবং পরিষ্কার করতে মামলার সব আসামিকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এছাড়া ভুক্তভোগী ওই নারীর স্বীকারোক্তি খতিয়ে দেখছি। গত তিন মাসে তারা কোন কোন হোটেলে ছিলেন, তার তথ্য সংগ্রহ করার পাশাপাশি তাদের মোবাইল ফোনের কললিস্ট ও সিডিআর সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এদিকে ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের’ অভিযোগে বৃহস্পতিবার রাতে ওই নারীর স্বামী বাদী হয়ে চারজনের নাম উল্লেখ ও তিনজনকে অজ্ঞাত আসামি করে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় চার আসামি হলো- কক্সবাজার শহরের মধ্যম বাহারছড়া এলাকার আশিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ শফি ওরফে ইসরাফিল হুদা জয় ওরফে জয়া, মেহেদী হাসান বাবু ও জিয়া গেস্ট ইন হোটেলের ম্যানেজার রিয়াজ উদ্দিন ছোটন। এরেই মধ্যে রিয়াজ উদ্দিন র্যা বের হাতে আটক হয়ে জেলহাজতে রয়েছেন।

কক্সবাজার সদর মডেল থানা পুলিশ জানান, ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত আশিকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন, ছিনতাই, ইয়াবা ব্যবসাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৬টি মামলা আছে। তার অন্যতম সহযোগী জয়ার বিরুদ্ধেও দুটি মামলা আছে। তারা মূলত কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল জোনের ত্রাস হিসেবে পরিচিত। তাদের গ্যাংয়ে অর্ধশতাধিক সদস্য রয়েছেন। তারা গ্রেফতারও হয়েছেন একাধিকবার।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শহরের হলিডে মোড়ের হোটেল সি-ল্যান্ডে বুধবার দুপুরে স্বামী ও আট মাস বয়সী সন্তানকে নিয়ে ওঠেন ওই নারী। তবে এ হোটেলের রেজিস্ট্রার খাতায় তিনি নিজের যে নাম লিখেছেন মামলার এজাহারের নামের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই।

হোটেল সি-ল্যান্ডের ম্যানেজার আজিজুল হক বলেন, বুধবার বেলা ৩টা ৫ মিনিটে তারা ওঠেন। ২০১ নম্বর কক্ষ ভাড়া নেন তারা। এরপর বিকালের দিকে বেরিয়ে যান। বেশ কয়েক ঘণ্টা পর রাত ১১টার দিকে তার স্বামী এসে বলেন স্ত্রীকে অপহরণ করা হয়েছে। আমি তাকে পুলিশের সহযোগিতা নিতে বলি। এরপর সে (স্বামী) চলে যাওয়ার পর রাতে আর কেউ আসেনি। পরের দিন বৃহস্পতিবার পুলিশসহ এসে তাদের মালামাল নিয়ে যায়।

র‌্যাবের কাছে দেওয়া ওই নারীর বক্তব্য অনুযায়ী, সৈকতের লাবনী পয়েন্টে বুধবার বিকালে তার স্বামীর সঙ্গে প্রথমে এক যুবকের বাগবিতণ্ডা হয়। এরপর অভিযুক্ত যুবকদের সঙ্গে যোগ দেয় আরও কয়েকজন। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে একটি সিএনজি অটোরিকশায় স্বামী ও সন্তানকে তুলে নিয়ে যায় তারা। আরেকটি অটোরিকশায় তিন যুবক ওই নারীকে জোর করে ঝুপড়ি চায়ের দোকানে নিয়ে যায়।

ঝুপড়ি দোকানটি চালান ছেনুয়ারা বেগম নামের এক নারী। ছেনুয়ারা বেগম জানান, বুধবার রাত ৮টার দিকে এক নারীকে নিয়ে আসেন স্থানীয় আশিক ও জয়া। তাদের সঙ্গে আরও এক যুবক থাকলেও তিনি তার পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি। ছেনুয়ারা বেগম জানান, আশিক ও জয়ের বাড়ি দোকানের আধা কিলোমিটারের মধ্যে। প্রায়ই তারা আসতেন বলে দুজনেই ছেনুয়ারার পরিচিত।

বুধবার রাত সোয়া ৮টার দিকে আশিক, জয়াসহ তিনজন সিএনজি অটোরিকশায় এসেছিল। তাদের সঙ্গে একটি মেয়েও ছিল। তারপর আমার দোকানের পেছনের দিকে গাড়ির হেলপারদের ঘুমানোর রুমে মেয়েটিকে নিতে দেখেছি। প্রায় আধাঘণ্টা পর রুম থেকে বের হয়ে চলে যায় তারা।

এ বিষয়টি নিয়ে কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, তদন্তের অংশ হিসেবে ছেনুয়ারাকে ওই নারীর মুখোমুখি করা হবে। প্রয়োজনে ছেনুয়ারাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।

ওই নারীর অভিযোগ অনুযায়ী, ঝুপড়ি চা দোকানটি থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জিয়া গেস্ট ইন হোটেলে। জিয়া গেস্ট ইনের রেজিস্টার খাতার তথ্য অনুযায়ী, ওই নারীকে নিয়ে আশিক বুধবার রাত ৯টা ৮ মিনিটে হোটেলে আসেন। খাতায় দুজনের নামই এন্ট্রি করার পর তাদের তৃতীয়তলার ২০১ নম্বর কক্ষ দেওয়া হয়। ওই সময় হোটেল ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন রিয়াজ উদ্দিন ছোটন। তাকে বুধবার গভীর রাতে আটক করে র্যা ব। র্যা বের দাবি- আশিকের সঙ্গে ছোটনের আগে থেকেই সখ্য ছিল।

ওই নারীকে হোটেলে নিয়ে যাওয়া এবং বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে লবির সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, হোটেলে যাওয়ার প্রায় ৪০ মিনিট পর রাত ৯টা ৪৫ মিনিটের দিকে বেরিয়ে যাচ্ছেন আশিক। তার কিছু সময় পর একাকী নেমে আসেন ওই নারী।

ওই নারীর অভিযোগ, রুমের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়ায় তিনি আটকে পড়েছিলেন। এরপর কক্ষের জানালা দিয়ে টেলিভিশনের রিমোটের একটি ব্যাটারি ছুড়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক যুবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে ওই যুবক এসে দরজা খুলে তাকে বের করেন।

তবে জিয়া গেস্ট ইনের আরেক ম্যানেজার আমির হোসেনের দাবি, তাদের হোটেলের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করা সম্ভব নয়। এটি শুধু ভেতর থেকে বন্ধ করার ব্যবস্থা রয়েছে। ওই নারীকে উদ্ধারের জন্য বাইরে থেকে কোনো যুবক হোটেলে প্রবেশ করেননি বলেও দাবি করেন আমির। তিনি দাবি করছেন, কক্ষ ভাড়া নেওয়ার সময় আশিকসহ দুজনকেই ‘স্বাভাবিক’ মনে হয়েছে হোটেল কর্মীদের।

এদিকে ভুক্তভোগী নারীর অভিযোগ মতে, ঘটনার পরপরই ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে পুলিশের সহযোগিতা চাইলে পুলিশ ঘটনাস্থলে না গিয়ে থানায় গিয়ে জিডি করতে বললে র‌্যাবকে ঘটনাটি জানান। এরপর রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে র্যা ব ওই হোটেলে যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, হোটেল-মোটেল জোনে যে নারী ধর্ষণের অভিযোগে ৯৯৯ নম্বরে ফোন দেওয়ার কথা বলছেন, তা আমরা জানি না। কারণ ৯৯৯ থেকে জেলা পুলিশের কাছে কোনো ফোন আসেনি। তারপরও ঘটনার খবর পেয়ে জেলা পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং ভিকটিমের সঙ্গে কথা বলেছেন।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ তোলা নারীর সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় ছিল অভিযুক্তদের। তাদের মধ্যে একটি লেনদেনও রয়েছে। এছাড়া হোটেল ও মামলার নথিতে স্বামী-স্ত্রী ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহার করেছেন। এসব আমাদের মধ্যে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি তদন্ত বিপুল চন্দ্র দে জানান, ধর্ষণের শিকার গৃহবধূর স্বামী ঢাকা যাত্রাবাড়ী এলাকার মামুন মিয়া বাদী হয়ে ৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ২-৩ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয়েছে কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশকে। মূলত মামলা রেকর্ডের পর থেকে এ ঘটনা সর্ম্পকে ট্যুরিস্ট পুলিশ তদন্ত করে যাচ্ছে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2023 DeshPriyo News
Designed By SSD Networks Limited
error: Content is protected !!