মাকসুদ রহমান: কথায় বলে নাম দিয়ে কী হয়? আসলে নামেই সবকিছুর পরিচয়। ইতালি একটি দেশ, আর সেই দেশের নাম কীভাবে ইতালি হলো? একজন ইতালি প্রবাসী হিসাবে তা জানার আগ্রহ সকলের থাকে। সেইসঙ্গে ইতালি যেহেতু প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রায় ৩ হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস বহন করে যাচ্ছে, তাই ইতালির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সমগ্র বিশ্বের মানুষের কাছে সবচেয়ে আগ্রহের বিষয়।
বিভিন্ন কারণে ইতালি ইউরোপীয় তথা বিশ্বসাহিত্যেও বিশাল স্থান দখল করে আছে। এখনো ইউরোপের যত প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে তার সবকিছুর সৃষ্টির মূলে রয়েছে রোমানরা। তাই ইতালি শব্দটির সৃষ্টি কীভাবে হলো? তা নিয়ে গবেষণার কোনো অন্ত নেই।
আধুনিক ইতালি বা বর্তমান ইতালির সৃষ্টি হয়েছিল ১৮৪৮ সাল থেকে ১৮৭১ সালের মধ্যে জিউসেফ গ্যারিবাল্ডির হাত ধরে। যখন ইতালির বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট রাজ্যগুলোকে তিনি যুদ্ধের মাধ্যমে এবং সমঝোতার মাধ্যমে বর্তমান ইতালিকে পুনরেকত্রীকরণ করেছিলেন। এর পূর্বে চতুর্থ শতাব্দীতে যখন রোমানরা নিজেদের শক্তি হারিয়ে ফেলেন, তখন ইতালি অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
শিশুর জন্মের পর তার নামকরণ তার চেয়ে বয়স্ক কিংবা পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজন দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। সেই ক্ষেত্রে ইতালি নামকরণটি ও তৎকালীন সময়ে যারা ইতালির চেয়ে বেশি সমৃদ্ধশালী সভ্যতার অধিকারী ছিল, তাদের কাছ থেকে বর্ণনা পাওয়া যায়।
সমগ্র বিশ্ব ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ১৮টি শক্তিশালী সভ্যতার পরিচয় মিলে। যাদের হাত ধরে আধুনিক বিশ্বের বর্তমান কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। সভ্যতার সবচেয়ে সফল ও বিশ্ব ইতিহাসে যাদের নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়, তা হলো গ্রিক সভ্যতা। তাই ইতালি শব্দটির সৃষ্টির ক্ষেত্রে গ্রিকদের বর্ণনায় এবং তাদের ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে যে তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়, তা সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত।
গ্রিক ঐতিহাসিক “অ্যান্টিওকাস অব সিরাকিউস” খ্রিষ্টপূর্ব ৪২০ সালে ইতালি সম্পর্কে তার লিখায় কাছাকাছি শব্দের উচ্চারণ করেছেন। যা পরবর্তীতে কয়েকশো বছর পরে আরেক গ্রিক বিখ্যাত ঐতিহাসিক ডায়োনিসিয়াস খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে সিরাকিউসের লিখার কিছু উদ্ধৃতি দিয়েছেন । তিনি লিখেন যে ট্রোজান যুদ্ধের ষোল প্রজন্মের আগে ,বর্তমান ক্যালাব্রিয়া অঞ্চলটিতে একজন রাজা ছিলেন,তার নাম ছিল ইটালুস”। পরবর্তীতে এই রাজা “ইটালুসের নাম পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান ইতালি নামের সৃষ্টি। ক্যালাব্রিয়া প্রদেশের কাতানজারো শহরে একটি রাস্তা রয়েছে । রাস্তাটির নাম ইতালুস যা হাজার বছরের পুরনো। স্থানীয় মানুষ রাস্তাটিকে ‘ইতালি’ নামের জন্ম স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যা সিরাকিউসের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়।
গ্রিক ঐতিহাসিক ডায়োনিসিয়াস ভিন্ন যুক্তিও তুলে ধরেন। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে ঐতিহাসিক হেলানিকাসের কথা উল্লেখ করেছেন। একদিন গ্রিক রাজা ইউরিস্টিয়াস হারকিউলিসকে তার শত্রু দানব গেরিয়ানের গবাদি পশুদের আক্রমণ করে তার কাছে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। হারকিউলিস রাজার নির্দেশ মতো সফল মিশন শেষ করে পশুর পালটিকে গ্রিসে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন একটি বাছুর সাঁতরে ইতালির সিসিলিতে পালিয়ে যায়। হারকিউলিস পালিয়ে যাওয়া বাছুরটি খুঁজতে থাকেন এবং তার নাম দেন ভিটিলাস, সেই সঙ্গে ওই এলাকার নাম দেন ভিটুলিয়া যার অর্থ বাছুরের দেশ।
হারকিউলিসের দেওয়া নাম ভিটিলাস বা ভিটুলিয়া কিংবা অ্যান্টিওকাস অব সিরাকিউসের বর্ণনায় রাজা ইটালুস ই হলো ইতালি নামের প্রধান উৎস বলে মেনে নেন আধুনিক ইতিহাসবিদরা। তবে রাজা ইটালুসের নাম অনুসারে ইতালির নামকরণ হয়েছে বলে মনে করেন অধিকাংশ ঐতিহাসিক।
এর বাইরে আরেকটি খুব জনপ্রিয় মত রয়েছে। তা হলো খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে রোমানদের বিপরীতে প্রতিযোগিতা করে সমনাইট, অরুঞ্চি ও সিডিসিনি উপজাতিরা মিলিতভাবে ভিটেলিউ স্ট্যাম্পের মুদ্রা তৈরি করে ছিলেন। যে নামটি হারকিউলিসের নামের সঙ্গে মিলে যায়। তবে ভিটালাস বর্তমানে ভেতেল্ল (বাছুর) শব্দটি ইতালিতে প্রচলিত। সুতরাং ভিটুলিয়া বা ভিটালুস বা ইটালুস ই হলো ইতালি নামের সৃষ্টির মূল শব্দ।
Leave a Reply