তনু হত্যার সন্দেহভাজনরা কোথায়
তনু খুন হয়েছে ৭ বছর পেরিয়ে গেল। হত্যারহস্য জট খুলে নি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু(১৯)। অগ্রগতি বলতে এপর্যন্ত চারবার পুলিশের তদন্ত সংস্থা ও পাঁচবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে। একজন আসামীও ধরা পড়েনি।
২০১৬ সালের ২০ মার্চ তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় স্পর্শকাতর সংরক্ষিত কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায়। রাত ১১ টার দিকে লাশ বাসার কাছের সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের কাছের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে মিলিটারি পুলিশ। তনুর বাবা ইয়ার হোসেন কুমিল্লা সেনানিবাস বোর্ডের অফিস সহায়ক। তারা সপরিবারে সেনানিবাসের কোয়ার্টারে থাকেন।
মামলার এজাহারে কাউকে আসামী করা না হলেও তনুর বাবা ইয়ার হোসেন ও পরিবারের বিভিন্ন সময়ে দেয়া গণমাধ্যমে ভাষ্যের সারসংক্ষেপ , তনুকে ঘটনার দিন প্রাইভেট পড়ানোর সময় সার্জেন্ট জাহিদের বাসা থেকে এক সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। তুলে নিতে সেখানে ধস্তাধস্তি হয়। ওই সেনাকর্মকর্তার স্ত্রী তনুকে পরে বাসায় পৌঁছে দেয়ার কথা বললে তনু মাকে ফোন করে জানানোর চেষ্টা করে। এ সময় তার হাত থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয়।
ওই সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীকে ফোন করে বাসায় ডেকে এনেছিলেন সার্জেন্ট জাহিদের স্ত্রী। বাংলাবাজারের দিকে ওই সেনাকর্মকর্তার বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময়টাকেই পরিবার নিখোঁজ বলছে। পরে তার লাশ অলিপুর পাওয়ার হাউজের সীমানা খোলা জঙ্গলে পাওয়া যায়। কারা কিভাবে ফেলে গেলেন। ওই কথাও জানিয়েছেন বাবা- মা, গণমাধ্যম তাই বলছে।
তনু বাসা থেকে তিন’শ গজ দূরে কুমিল্লা সেনানিবাসের অলিপুর ১২ ইঞ্জিনিয়ার্স ব্যাটালিয়নের কোয়ার্টারে সার্জেন্ট জাহিদের মেয়েকে পড়াতো। সার্জেন্ট জাহিদের বাসায় যাওয়ার আগে সে সিপাহী জাহিদের বাসায় পড়াতে যায়। দু’টি বাসা মুখোমুখি। পরে অবশ্য দু’জাহিদকেই ঢাকায় বদলী করা হয়। দুই জাহিদ ও সার্জেন্ট জাহিদের স্ত্রীকে কয়েকদফা জিজ্ঞেসাবাদের তথ্যও জানায় সিআইডি। শুধু তাই না প্রায় দু’শ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার দাবী তাদের। যাদের এক’শ জনই সামরিক বাহিনীর সদস্য। তবে জিজ্ঞাসাবাদে কিছু মিলেছে কিনা, তা জানানো হয় নি।
হত্যাকাণ্ডের দু’দিন আগে ১৮ মার্চ সেনানিবাসে একটি কোরের অনুষ্ঠান হয়েছে। আর হত্যাকাণ্ডের রাত ২০ মার্চের নির্ধারিত অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে। তনু ওই অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেছে।
তবে আশা জেগেছিল যে তথ্যে, তা বেশ চমকপ্রদ। তনুর পরিধেয় পোষাকে তিন পুরুষের আলামত মিলেছে ডিএনএ রিপোর্টে। এটা অবশ্য হত্যার পরের বছরের মে মাসের ঘটনা। এরা কারা। এরজন্যে প্রয়োজন সন্দেহভাজনদের ডিএনএ ম্যাচিং। বেশ ক’জন সন্দেহভাজনের ডিএনএ করা হলেও পরিচয় আর মিল পাওয়া গেছে কিনা তা আর জানানো হয় নি। এরপর থেমে গেছে, পেরিয়েছে ছয় বছর। অবশ্য তখনই সিআইডি কাছাকাছি পৌঁছার আশাবাদ জানিয়ে ছিল। সিআইডিই দীর্ঘদিন এ মামলা তদন্ত করেছে।
ডিএনএ নিউইয়র্ক ও ইংল্যান্ডে করা হয়। সন্দেহভাজন কারা তাও জানানো হয় নি। এরা সামরিক না বেসামরিক, সামরিক হলে অফিসার নাকি জেসিও তাও জানানো হয় নি। উল্টো সেনানিবাস এলাকার আইন-কানুনে তদন্ত ধীর ও প্রক্রিয়াগত ভাবে করতে সময় লাগে এমনটাই বলা হয়- যখন সিআইডি তদন্তে তৎপর ছিল। এরপর পিবিআই তদন্তে এলো, সেই থেকে নিশ্চুপই বলা চলে।
এখন আশাটা এমন, অনেক বছর পরও কোন সন্দেহভাজন ব্যক্তির ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া গেলে, তার সাথে তনুর পোষাকে পাওয়া ডিএনএ মিলে গেলেই একটা ইতি হয়তো তদন্তে টানা যাবে। কারন তনুর পোষাকে পাওয়া ডিএনএ বদলানোর সুযোগ নাই। ফলে অপরাধীরা আইনের আওতায় আসবেই।
মরদেহ দু’দফা ময়নাতদন্ত হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় কবর থেকে তুলে। এরপরও মৃত্যুর কারণ বলতে পারে নি কুমিল্লা মেডিকেলের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা। তনুকে ধর্ষণের কথা প্রথম জানায় পুলিশ, আলামত বিশ্লেষণে সিআইডিও একই কথা বলেছে। কিন্তু কুমেক ফরেনসিক তাও বলে নি। কুমেক মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের যে ডাক্তার তা নেগেটিভ বলেছেন তিনি এক সামারিক কর্মকর্তার স্ত্রী ছিলেন। পরে তাকে বদলী করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। অবশ্য ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদেরও জিজ্ঞাবাদ করে সিআইডি। কিছু আলামত নিয়েতো চিকিৎসক- সিআইডি যুদ্ধ বাঁধে। পরে তা আদালতে নিষ্পত্তি হয়।
প্রথম ময়নাতদন্তের চিকিৎসকতো তনুর ডান কানের জখমকে পোকামাকড় বলেছেন। সুরুতহালে পুলিশ মাথা থেঁতলানো ছিল বলে লিখেছে। আর ব্যবহার্য নীচের আন্ডারওয়্যার একটিই পেয়েছিল সুরুতহাল করার সময় পুলিশ, এটাই স্বাভাবিক। পরে লাশ উদ্ধার করা মিলিটারী পুলিশ আরও একটি আন্ডারওয়্যার পাঠায় উদ্ধার হওয়া আলামত হিসাবে। কারা রাগে- ক্ষোভে তনুর চুল কেটে দিয়েছিল। ওই চুল কাটতে যেয়েই তার ডানকান জখম হয়। এসব তথ্য-প্রশ্ন তদন্ত সংশ্লিষ্টদেরই। তারাই বিভিন্ন সময়ে এসব জানায়, যা গণমাধ্যমে এসেছে।
প্রথমদিকে তনুর পরিবারের অভিযোগ ছিল তারা কোথাও যেতে পারেন না। তাদের ফলো করা হয়। আর এখনকার ভাষ্য, জিন্দা লাশ হয়ে বেঁচে আছি। বাবা- মা দু’জনই অসুস্থ। কয়েকবার হাসপাতালেও ছিলাম। সংসারটা তছনছ হয়ে গেছে। দুর্গতির শেষ নেই। তদন্ত কর্মকর্তা অনেক- দু’বছর আসেন নি। প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চেয়েছেন, পারেন নি। এখন বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। বেঁচে থাকতে দেখে যেতে পারবেন না, এমনটা ভাবছেন। যদিও ঘটনার দু’বছরের মাথায় বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, সব আর্মির কথা বলছি না, যে মারছে তার বিচার করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে।
চাঞ্চল্যকর এই মামলা ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর সিআইডি থেকে আসে পিবিআইয়ের কাছে। তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকার পরিদর্শক মোঃ মজিবুর রহমানের গণমাধ্যমে ভাষ্য, আমি কিছু বলতে পারবো না। সিনিয়র কর্মকর্তারা বলবেন। পিবিআই প্রধান বনজ কুমারের ভাষ্য, তদন্ত চলছে, অগ্রগতি নেই, একদিন এ হত্যারহস্য উন্মোচন হবে। বক্তব্যে কোন সুনির্দিষ্টতা নেই। একদিন, কখন আসবে। প্রশ্ন হলো তনু হত্যার সন্দেহভাজন কারা, কোথায় এরা। সিআইডির তদন্ত সময়ের দাবী অনুযায়ী তারা কাছাকাছি চলে গিয়েছিল, সে ধারাবাহিকতায় পিবিআইয়েরতো গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা। তনু হত্যার বিচার দাবীতে দেশ উত্তাল হয়েছিল। জনমনে ওই রেশ এখনও কাটে নি।
লেখকঃ মাসুক আলতাফ চৌধুরী, সাংবাদিক।সাবেক সভাপতি-কুমিল্লা প্রেসক্লাব
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply