বুধবার, ০৭ জুন ২০২৩, ০৯:১৪ পূর্বাহ্ন

পিকে হালদারের অর্থ লোপাটের নেপথ্যে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী

যুগান্তর
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২১ মার্চ, ২০২১
  • ৬০৬ বার

চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনার নেপথ্যে পিকে হালদারের (প্রশান্ত কুমার হালদার) একাধিক বান্ধবীর সংশ্লিষ্টতার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

সূত্র জানায়, দুদকের একজন উপ-পরিচালকের নেতৃত্বে গঠিত অনুসন্ধান টিম সম্প্রতি কমিশনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। সেখানে বলা হয়েছে, পিকে হালদারের উচ্চাভিলাষী এবং লিজিং কোম্পানি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটের পেছনে কাজ করেছে তার ত্রিভুজ প্রেম। দুই প্রেমিকার কাছে নিজের বীরত্ব প্রকাশ করতে এবং নিজেকে শিল্পপতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার অসীম প্রতিযোগিতার লালসা থেকে লিজিংয়ে গ্রাহকের আমানত লুট করেন পিকে হালদার। এজন্য নিজের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু ছাড়াও ঘনিষ্ঠ একাধিক বান্ধবীকে ব্যবহার করেন।

২০১৫ সালে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি হিসাবে নিয়োগ লাভ করার পর বান্ধবী রুনাইকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে পাঠান পিকে। পরোক্ষভাবে তাকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের নির্বাহী ক্ষমতাই দেন। দুদকের কাছে অনেকেই বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, পিকে হালদার রুনাইকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং উপহার দেন। এছাড়া অপর বান্ধবী অবন্তিকাকে খুশি করতে পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার ক্রয় করে সেখানে তাকে বসান।

দুদকের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে নাহিদা রুনাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ হেড অব বিজনেস হিসাবে যোগদান করেন। এমডি হিসাবে যোগ দেন রাশেদুল হক। মূলত পিকে হালদারের নির্দেশেই লিজিংয়ের সব কাজ পরিচালিত হতো। সবার উপর ছড়ি ঘোরাতেন রুনাই। সোহাগ ও রাফসান রিয়াদ নামের দুই কর্মকর্তা পিকে হালদারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র নিয়ে রুনাইকে দিতেন। পরে রুনাইয়ের নির্দেশ মতো ঋণের ক্রেডিট মেমো প্রস্তুত করা হতো। এমনকি পর্ষদেও অনুমোদন হতো। সব ঋণ বিতরণই পিকে হালদারের নির্দেশ মতো হতো। সব বিষয় মনিটরিং করতেন প্রেমিকা নাহিদা রুনাই। তাকে কেন্দ্র করে ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে সরানো হয় ২৪০০ কোটি টাকা। নাহিদা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে ট্রেনিং অফিসার হিসাবে যোগদান করার পরই প্রতিষ্ঠানটির এমডি পিকে হালদারের নজরে পড়েন। গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠতা।

অপরদিকে অবন্তিকা পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাধে তাকে প্রথমে আর্থিক প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্সে টেলিফোন অপারেটর চাকরি নেন। অভ্যর্থনা কক্ষের চাকরি হলেও তিনি সরাসরি পিকে হালদারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। এভাবেই গড়ে ওঠে সখ্য। দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৩-১৪ সালের দিকে গোপনে ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে দুই বান্ধবীকে নিয়ে যাতায়াত শুরু করলেও একপর্যায়ে নাহিদা রুনাইকে নিয়ে গোপনে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া ভ্রমণ শুরু করেন পিকে হালদার। একইভাবে অবন্তিকাকে নিয়েও গোপনে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর যাতায়াত শুরু করেন। এক সপ্তাহে রুনাইকে নিয়ে গেলে পরের সপ্তাহে অবন্তিকাকে বিদেশে নিয়ে যেতেন। একজনের বিষয় অপরজন জানত না। হঠাৎ এক ক্লাবের মিটিংয়ে দুজনই জানতে পারেন পিকে হালদার দুজনের সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। এটি জানার পর বান্ধবীদের মধ্যে পিকে হালদারকে নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। গ্রেফতার হওয়া উজ্জ্বল কুমার নন্দীর বক্তব্য থেকেও এর সত্যতা মিলেছে। তিনিও বলেছেন, বান্ধবী- নাহিদা রুনাই ও অবন্তিকাকে নিয়ে তিনি লিজিং সভার নামে পৃথকভাবে ২২-২৫ বার মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেছেন।

দুদকের এ সংক্রান্ত অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার বলেন, পিকের ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসছে। তিনি নিজের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য একদিকে যেমন নারীদের ব্যবহার করেছেন। তাদের নামে বিপুল সম্পদ গড়ে দিয়েছেন। অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসকে সুর ও শাহ আলমসহ একটি সিন্ডিকেট তিনি ‘মেনটেইন’ করতেন। তাদের হাতেও মোটা অঙ্কের অর্থ তুলে দেন। এসব বিষয়ে চুলচেরা অনুসন্ধান চলছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত কাগজপত্র পর্যালোচনা এবং নিজস্ব অনুসন্ধানে দুদক দেখতে পায়, পিকে হালদার ঋণের নামে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করলেও এখন সুদে-আসলে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। বেশিরভাগই ঋণের ক্ষেত্রে মর্টগেজ ছিল না, থাকলেও তার পরিমাণ খুবই নগণ্য, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মর্টগেজ নেয়ার কথা থাকলেও পরে তা নেয়া হয়নি। অথচ ঋণ হিসাব থেকে সব টাকা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে ঋণ পরিশোধ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় দুদকের প্রতিবেদনে।

ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে শুধু একটি কম্পিউটার ব্যবহার করে কিভাবে রাতারাতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট করা যায় তা পিকে হালদার দেখিয়েছেন। আর্থিক খাতে সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে অন্তত ১৪০০ কোটি টাকা বিভিন্ন দেশে পাচারের পর নিজে কানাডায় পাড়ি জমান

এদিকে, পিকের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে পাঁচটি মামলা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি রাশেদুল হক, হেড অব বিজনেস নাহিদা রুনাই, সিনিয়র ম্যানেজার রাফসার রিয়াদ চৌধুরী, ভারপ্রাপ্ত এমডি সৈয়দ আবেদ হাসান, পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীকে গ্রেফতার করে দুদক। রোববার (আজ) ৪৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে আরও ৩৭ জনকে আসামি করে পৃথক পাঁচটি মামলা হচ্ছে বলে জানান অনুসন্ধান কর্মকর্তা।

যুগান্তর।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2023 DeshPriyo News
Designed By SSD Networks Limited
error: Content is protected !!