প্রকল্পের অধীনে ভ‚মিহীনদের ঘর নির্মাণ নিয়ে অনিয়মের এ ঘটনায় সংশ্নিষ্ট জেলা প্রশাসকরা তদন্ত কমিটি করেছেন। সে সঙ্গে সব ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিদর্শন দলের সদস্যরা। এ প্রতিবেদনে ঘর নির্মাণে অনিয়ম ও কর্মকর্তাদের অবহেলার তথ্য উঠে এসেছে। তারই ভিত্তিতে ইউএনও ও এসিল্যান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী পাঁচজন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। এটা মাত্র শুরু। তদন্তে দেড় শতাধিক কর্মকর্তার নাম এসেছে। পর্যায়ক্রমে সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানা গেছে।
সৈয়দপুর (নীলফামারী) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় নীলফামারীর সৈয়দপুরে দ্বিতীয় দফায় নির্মিত ঘরের দেয়ালে ও বারান্দার পিলারে ফাটল ধরেছে। সামান্য বৃষ্টিতেই পড়ছে পানি। টিনের ছাউনিতে ব্যবহার করা হয় নিম্নমানের কাঠ। এখনই গ্রীলের দরজা-জানালার পাল্লাগুলো খুলে খুলে পড়ছে। আর ৫১টি ঘরের বেশিরভাগ ঘরেরই গ্রীলের দরজা-জানালা ঠিকভাবে আটকানো যায় না। ফলে নিরাপত্তাহীনতায় পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছে সুবিধাভোগী পরিবারগুলো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলায় মোট ৯৪টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দফা ৩৪টি এবং দ্বিতীয় দফায় ৬০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। যা ইতোমধ্যে সুবিধাভোগীদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ সব ঘরে সুবিধাভোগীরা পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাসও করছেন। প্রথম দফায় নির্মিত প্রতিটি ঘরের জন্য ব্যয় বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭১ হাজার এবং দ্বিতীয় দফা ৬০টি ঘরের প্রতিটির জন্য নির্মাণ ব্যয় ধরা ছিল ১ লাখ ৯১ হাজার টাকা। প্রথম দফায় নির্মিত ঘরগুলো নির্মাণে তেমন কোনো বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হয়নি। কিন্তু বিপত্তি ঘটে আশ্রয়ণ প্রকল্পের দ্বিতীয় দফায় ৬০টি ঘর নির্মাণ কাজে। এতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হয়েছে।
উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের ধলাগাছ আশ্রয়ণ প্রকল্পে নির্মাণের দুই-তিন মাস যেতে না যেতে সে সব ঘরের দেয়ালে ও বারান্দার পিলারে ফাটল ধরেছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩৫ নম্বর ঘরের সুবিধাভোগী শেফালি খাতুন তার ঘরের বারান্দার পিলারের ফাটল দেখিয়ে দিয়ে অভিযোগ করে বলেন, এখনই যদি এ অবস্থা হয়, তবে বাকি দিনগুলো আমি স্বামী সন্তান নিয়ে কিভাবে এ সব ঘরে বসবাস করব। এ রকম ঘরের দেয়ালে ও পিলারে ফাটল ধরেছে সুমী নামের সুবিধাভোগীর ৫১ নম্বর ঘরেও। সামান্য বৃষ্টিতে পানি পড়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সুবিধাভোগী এমদাদুল হকের ৪৯ নম্বর ঘরসহ অনেকের ঘরেই বৃষ্টি পানি পড়ে। তাই বৃষ্টি পানি থেকে ঘরের জিনিসপত্র রক্ষায় অনেককে পলিথিন ব্যবহার করতে দেখা যায়। ৩৩ নম্বর ঘরের বাসিন্দা মো. ইসহাক বলেন, ঘরের প্রধান দরজাটি লাগানো যায় না। তাই বাধ্য হয়ে সামনে থেকে ঘরের প্রধান দরজা তালাবদ্ধ করে পেছনে দরজা দিয়ে ঘরে থাকতে হচ্ছে।
চিলমারী (কুড়িগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর অধিনে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের তত্ত¡াবধানে আশ্রয়ণ প্রকল্প মাটি ভরাটের কাজ হয়। চর ফেসকা বাবদ হাতিয়া বকসী আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাটি ভরাট বাবদ প্রায় ৭শত মে: টন গম বরাদ্দ দেয়া হয়। শুরু থেকেই মাটির ভরাট কাজেও নেয়া হয় অনিয়মের আশ্রয়ণ ফলে বৃষ্টির সাথে সাথে বিভিন্ন স্থানে মাটির ধস দেখা দেয়। জোড়াতালি আর অনিয়মের মধ্য দিয়ে মাটির কাজ সমাপ্ত করে তা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তর করেন স্থানীয় প্রশাসন।
কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৬ পদাতিক ডিভিশন রংপুর সেনানিবাস এর বাস্তবায়নে ৪৮টি ব্যারাক নির্মাণের সহায়তা করেন মেসার্স হাওলাদার এন্টারপ্রাইজ, বরিশাল। ব্যারাক নির্মাণের পর গত কয়েকমাস আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী স্থানীয় প্রশাসনকে ৪৮টি ব্যারাকের ২৪০ পরিবারের ঘর হস্তান্তর করেন। পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় আশ্রয়হীন পরিবারকে পরিবার প্রতি ১টি করে ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়। আশ্রয়হারা মানুষজন একটি আশ্রয়ের ঠিকানা আর পাকা ঘর পেয়ে যেমনটি আনন্দিত হয়েছিল ঘর ও মাটির ধসের সাথে তাদের আনন্দ গেছে উড়ে সুখের স্বপ্ন যেন ধসে পড়তে শুরু করেছে। বুধবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মাঠের বিভিন্ন স্থানে স্থানে মাটি ধসে গেছে এবং ধসে গেছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ব্যারাক।
এসময় কথা হলে বৃদ্ধা সাহিদা (৫৫) বলেন বহে কি আর কমু নদী সউগে ভাঙ্গি নিচে আছিনু বান্দের রাস্তাত (বাঁধে) সেটাও ভাঙ্গি দিছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মানুষ, পরে আশ্রয়ণ কেন্দ্রে আশ্রয় পাইছোং। মনে বড় সুখ পাছিনু কিন্তু সেই সুখ উড়ে গেইছে, এই ঘরত (ঘরে) থাকতে ভয় হয় খালি মনে হয় কখন যেন ভাঙ্গি যায়, কন না বাহে ঘরের যে অবস্থা জীবন হামার যেন কচুর পাতায় পানির মতো হবার নাগছে, (কয়না কচুর পাতার পানি এই বুজি পড়ে তেমন হইছে) আর মনে হয় কখন জানি ভাঙ্গি পড়ে এই বুঝি জীবন হারাই।
শেরপুর (বগুড়া) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার খানপুর বুড়িগাড়ি এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরের পেছনের মাটি পাশের খালে ধসে পড়ছে। খালটিতে বাঁশের পাইলিং করে প্রকল্পের বাড়িগুলো রক্ষার চেষ্টা চলছে। এছাড়া বেশিরভাগ এলাকায় ব্যক্তিমালিকানা জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর করা হয়েছে। নিয়ে আদালতে মামলা হয়েছে। তারপর উপজেলা প্রশাসন বিষয়টি সমাধান করেনি। ইউএনও ময়নুল ইসলাম বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো রক্ষায় সব রকম চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
মির্জাপুর (টাঙ্গাইল) সংবাদাতা জানান, উপজেলার রশিদ দেওহাটা গ্রামে গিয়ে দুটি বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। উপকারভোগীরা বলছেন, দুর্যোগসহনীয় ঘর এখন নিজেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তবে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দাবি, নতুন মাটি ফেলে তড়িঘড়ি করে ঘর নির্মাণ করায় পাশাপাশি দুটি ঘরে এই ফাটল দেখা দিয়েছে।
বরগুনার তালতলী উপজেলার ছোটবগী ইউনিয়নের ঠাকুরপাড়া গ্রামের দুই ভাই, তাঁদের চাচা ঠাকুরপাড়া গ্রামের রশিদ ফকির এবং তাঁর দুই সন্তানসহ এক পরিবারের পাঁচজন ঘর পেয়েছেন। ওই ঠাকুরপাড়া গ্রামের ১৭ জনের নাম রয়েছে ঘর বরাদ্দের তালিকায়। তাদের অনেকেই সরকারি দলের নেতা।
Leave a Reply