হাসিব চৌধুরী :একটি দেশ, যার রয়েছে নিজেস্ব ভাষা ,সংস্কৃতি ,কৃষ্টি ঐতির্য, কিন্তু দেশটি পরাধীনতার সৃঙ্খলে বন্দী হাজার বৎসর ধরে। যে দেশের মানুষেরা সীমাহীন শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতনকে জীবনের নিত্য সঙ্গী করে নীরবে সহ্য করে যাচ্ছিলো ,আর অপেক্ষায় ছিল একজন দিকনির্দেশক মহামানবের ,যে কিনা সমগ্র বাঙালি জাতিকে অনুপ্রানিত করে সৃষ্টি করবে স্বাধীন সার্বভোম একটি রাষ্ট্র, মুছে ফেলবে পরাধীনতার সকল গ্লানি। অবশেষে সকল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবির্ভুত হলেন সেই মুক্তিকামী মানুষের কাণ্ডারি।যে মানুষটি কিশোর বয়স থেকেই অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায় ,সকল বৈষ্যমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ , ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন, পাকিস্তানী অপশাসনের বিরুধ্বে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সঠিক উপায়ে কাজে লাগিয়ে তৈরী করেছেন কালজয়ী ইতিহাস , যদি তাঁর নাম না-ও বলি ,যে মানুষটির চেহারা সামনে চলে আসবে , আমি তাঁরই কথা বলছি । জীবনের আরাম-আয়েশ, ধন-সম্পদ, প্রভাব ,প্রতিপত্তি, ক্ষমতা, পারিবারিক সুখ কোন কিছুই তাঁকে করতে পারেনি প্রভাবিত । সব কিছুকে তুচ্ছ ভেবে সহ্য করেছেন জুলম ,নির্যাতন ,কাঁটিয়েছেন জীবনের গুরুত্ব পূর্ণ ১৪টি বৎসর জেলে, করেছেন অগণিত আন্দোলন সংগ্রাম। পরাধীনতার সৃঙ্খল থেকে মুক্তির প্রত্যয়ে ঘুমন্ত জাতিকে করেছেন জাগ্রত , রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্য করেছেন প্রস্তুত । নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন এক অনন্য উচ্চতায় , প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন মানবতার মুক্তিদূত রূপে ,অনেক সংগামী ইতিহাসের পরিক্রমায় যথা সময়ে সমগ্র জাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন পরাধীনতার সৃঙ্খল ছিঁড়ে ,মুক্তিযুধ্বে ঝাঁপিয়ে পড়তে। যে ক্ষণটির জন্য হাজার বছর ধরে অপেক্ষায় ছিল পরাধীন সৃঙ্খলিত বাংলা , সেই শুভ ক্ষনে মুক্তির-দূত , বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি ,বাঙ্গালি জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা।
২৫ শে মার্চ রাত ৯/১০ টার দিকে তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতার ঘোষণা সম্বলিত একটি চিরকুট বঙ্গবন্ধুর হাতে দিয়ে কিছুক্ষন কথা বলেন, এটাই ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের কোনো নেতার সাথে বঙ্গবন্ধুর শেষ আলোচনা। এর পূর্বে অন্যান্য গুরুত্ব পূর্ণ নেতৃবৃন্দের সাথে বঙ্গবন্ধু পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করেন। অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপনে চলে গিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পরামর্শ দেন ,আবার অনেকে টেপ রেকর্ডারের মাধ্যমে ঘোষণা দেয়ার জন্য বলেন।অন্য দিকে স্বাধীনতা ঘোষণা ট্রান্সমিট করার জন্য ঢাকার বলদা গার্ডেনে একটি বেতার ট্রান্সমিটার সহ প্রস্তুত রয়েছেন বেতারের ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হক। বঙ্গবন্ধু সকলের কথা শোনেন কিন্তু তিনি কি করবেন এই ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে সকল নেতৃবৃন্দকে আত্মগোপনে চলে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন এবং তাঁর সর্বশেষ নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করতে বলেন। কি করবেন বঙ্গবন্ধু ? পড়ে গেলেন মহা মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্বে ! কি হতে পারে সঠিক সিদ্ধান্ত ? কারণ তিনি জানতেন তাঁর সিদ্ধান্তে যদি কিঞ্চিৎ ভুল থেকে যায়, তাহলে বিগত সকল আন্দোলন সংগ্রাম ,সব কিছু বিফলে চলে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র । অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ৩২ নং ধানমন্ডি, নিজ বাসভবন থেকে অর্থাৎ আত্মগোপনে না গিয়ে যথা সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন। অনেকেই বঙ্গবন্ধুর এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে সহজ সরল কান্ডজ্ঞানহীন তির্যক সমালোচনা করার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চিন্তা শক্তিতো আর এতো সরলীকরণ হতে পারে না, তিনি ছিলেন দূরদর্শী গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পন্ন একজন জন-নন্দিত নেতা , তিনি জানতেন স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে তাঁর দেশের জনগণের সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন , অন্যথায় ব্যাপক প্রাণহানির পরেও হয়তোবা , মুক্তির সংগ্রাম অনেক দীর্ঘায়িত হয়ে যেতে পারে, এমনকি ভেস্তে যেতে পারে। সকল কিছু বিবেচনায় রেখে তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্ত ,প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল অত্যন্ত সতর্কতার সাথে । এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পিছনে বঙ্গবন্ধুকে বিবেচনায় রাখতে হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সম্ভব্য পরিস্থিতি।
* তাঁকে ভাবতে হয়েছে আপাময় মুক্তিকামী কোটি জনতার কথা, যাদের দিকে তাক করা রয়েছে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বন্দুকের নল। তিনি যদি আত্ম গোপনে চলে যান তাহলে নির্বিচারে হত্যা করা হতে পারে সাধারণ জনতাকে। আর যদি আত্ম গোপনে না যান তাহলে প্রথমেই সমস্ত ঝুঁকি চলে আসবে তাঁর উপর অৰ্থাৎ তাঁকে হত্যা করা হতে পারে , সেই সাথে হত্যা করা হতে পারে তাঁর পরিবারের সকল সদস্যকে।
* অন্যদিকে যদি তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, তাহলে নির্যাতন ও হত্যার ভয় দেখিয়ে স্বাধীনতার বিপক্ষে বিবৃতি প্রদানে বাধ্য করা হতে পারে। বঙ্গবন্ধু জানতেন তাঁর দৃঢ় শক্ত মনোবলের কাছে পাকিস্তানিদের সকল নির্যাতন, ভয়- ভীতি পরাজিত হতে বাধ্য। এমনকি সর্বশেষে তাঁকে হত্যা ও করা হতে পারে ,যার জন্য তিনি ছিলেন সর্বদা প্রস্তুত ।
* একটু বাস্তব ভিত্তিক চিন্তা করলে দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আন্তর্জাতিক বিশ্ব কর্তৃক স্বীকৃত,নিয়মতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত একজন গণতান্ত্রিক নেতা, তিনি যদি আত্মগোপনে না গিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন তাহলে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে ,সেটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে মূল ভাবনা। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত এমন একজন নেতাকে যদি গ্রেফতার অথবা হত্যা করা হয় , তাহলে আন্তর্জাতিক ভাবে তথা বিশ্বের ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রের জনগণের কাছে এমনকি নিজ দেশের জনগণের কাছে পাকিস্তানী সরকার ধিক্কার ও ঘৃণা পাত্র হিসেবে বিবেচিত হবে। সেই সাথে অন্যান্য রাষ্ট্র সমূহ তাঁর জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলার মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে থাকতে বাধ্য হবে। সেক্ষেত্রে বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানিরা তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে এতো সহজে হত্যা করতে সক্ষম হবেনা। তিনি দেখলেন তাকে হত্যা কিংবা গ্রেফতার যা-ই করা হোক না কেন পাকিস্তানিদের এ ধরণের হীন কার্য স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় ও কোটি মানুষের সংগ্রামকে আরো ত্বরান্বিত করবে।
* বঙ্গবন্ধু চাইলে ভারতের সীমানায় প্রবেশ করে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারতেন ,কিন্তু এতে পরিস্থিতি হতে পারতো বিপরীত মুখী , যেমনটি হয়েছে তিব্বতের দালাইলামার ,১৯৫৯ সালে চীনের বিপক্ষে স্বাধিকার আন্দোলন করতে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে সরকার গঠন করেন ,কিন্তু ভারত সামরিক ও আর্থিক ভাবে সহযোগিতা না করায় তিব্বতিদের সকল সংগ্রাম স্তিমিত হয়ে যায়। সিকিমের রাজা পালডেন নামগিয়াল তিনি রাজতন্ত্র বিরুধী আন্দোলনকে প্রতিহত করতে ভারতের দ্বারস্থ হন , কিন্তু ভারত সেই সুযোগে এমন একটি চুক্তি করতে সক্ষম হয় যার কারণে সেই সময়ে সিকিম হয়ে যায় ভারতের আশ্রিত রাজ্য। কাশ্মীরের রাজা রণজিৎ শিং তার দেশের বিদ্রোহীদের প্রতিহত করতে ভারতের দ্বারস্থ হলে তিনি ও একটি নতজানু চুক্তি করতে বাধ্য হন , যার কারণে ভারত আর্টিকেল ৩৭০ জারী করে এবং কাশ্মীরে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় ।বঙ্গবন্ধু যদি ভারতের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেন, এমনটাও হতে পারতো ভারত সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য এমন সব জটিল শর্ত জুড়িয়ে দিতে যার কারণে স্বপ্নের বাংলা হয়তো হয়ে যেতে কাশ্মীর , সিকিম কিংবা তিব্বতের মতো। অতীতে যারাই ভারতের উপর সম্পর্ণ নির্ভর করেছে ,তারা স্বার্থ রক্ষা তো দূরের কথা, অবশেষে ভারতের কাছে স্বাধীনতা বিকিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।
* অন্য দিকে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষে আঁতাত করছে। বঙ্গবন্ধুর কোনো পদক্ষেপ যদি একটু ভুল হয়ে যায় , তাহলে মুক্তির সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী রূপ দেয়া তাদের পক্ষে খুব কঠিন ছিল না , এবং আন্তর্জাতক বিশ্বকে পাকিস্তানের পক্ষে নিয়ে সকল সংগ্রাম অর্থহীন করে তুলতে সর্ব শক্তি নিয়োগ করে দিতো এবং যুক্তরাষ্ট্র এখানে স্থায়ী ভাবে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে সফল হয়ে যেত , সে ক্ষেত্রে আমাদের ৯ মাসের যুদ্ব হতে পারতো ১০ বৎসর কিংবা ২০ বৎসর, কিংবা অনাদিকাল ।
বঙ্গবন্ধু সব দিক বিবেচনা করে অবশেষে নিজেকে ও তাঁর পরিবারকে নিশ্চিত মৃত্যু ঝুঁকিতে রেখে আত্ম গোপনে না গিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এবং পাকিস্তানিদের জন্য এমন একটি ফাঁদ তৈরী করেন যে তারা যদি বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার কিংবা হত্যা করে উভয়ই তাদের জন্য হবে হিতে বিপরীত । পরবর্তীতে তার এই সিদ্ধান্ত যে কত দূরদর্শী ছিল তাঁর প্রমান মেলে মুক্তিযুদ্বের দীর্ঘ নয় মাস সময়ে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পর সমস্ত বিশ্বে হৈ চৈ পড়ে যায় , এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলার মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে মতামত ও সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে থাকে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সসন সরকার যখন মুক্তিযুদ্বের বিরোধিতা করছিলো সেই মুহূর্তে আমেরিকার সাধারণ জনতা ও পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলার মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন দিতে থাকে এবং নিক্সসন সরকার চাপে পড়তে বাধ্য হয় ,যার কারণে সপ্তম নৌ বহর পাকিস্তানের পক্ষে ভারত মহাসাগরে এসেও বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় প্রবেশ করতে সাহস করেনি ।
সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সেই মহেন্দ্রক্ষণ ২৬ মার্চ ১৯৭১ প্রথম প্রহর , ১২ টা ২০ মিনিট , সেই রাতে ঢাকার বলদা গার্ডেনে পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে স্থাপিত গোপন রেডিও ট্রান্সমিটার থেকে ই পি আর চট্রগ্রাম হেডকোটারে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশেষ বার্তা ”স্বাধীনতার ঘোষণা” যা মুহূর্তেই সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলো,যার প্রমান আমরা পাই সেই সময়ে ( রাত ২ টা ১০ মিনিট, ২৬শে মার্চ ১৯৭১) মার্কিন রাষ্ট্রদূত কর্তৃক স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো বার্তা থেকে । স্বাধীনতার ঘোষণার এই বার্তাটি যখনই পাকিস্তানিরা নিশ্চিত করে ,কালক্ষেপন না করে প্রথমেই গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে।
”This may be my last message, from today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.”(এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।)—– শেখ মজিবুর রহমান।
অপারেশন সার্চ লাইট ,বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার এবং বঙ্গবন্ধু প্রদত্ব স্বাধীনতার ঘোষণাটি সেই সময় অর্থাৎ ১৯৭১ এর ২৬শে মার্চের পর মুহূর্ত থেকে আন্তর্জাতিক টেলিভিশন এ বি সি বিশেষ বুলেটিন প্রচার করতে থাকে ,এই সংবাদটি বিশ্বের অন্তত ২৫ টিরও অধিক দেশ থেকে গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হয়েছে।
‘* স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে বিদেশী সংবাদপত্র ও টেলিভশন মাধ্যমে ঐ দিন যে ভাবে প্রচারিত হচ্ছিলো তা এখন ও বিভিন্ন আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে এর একটি সংকলন আ.ফ.ম সাঈদ কর্তৃক লিখিত ” ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস ” বইটিতে উদৃত রয়েছে।
* ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়েছিলো:”….ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের নিকট সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন…”।
* দি ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন: ,,,২৭শে মার্চ দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ‘সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান: শেখ এ ট্রেইটর, সেইস প্রেসিডেন্ট’শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন ঘোষণা ও ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক বলার কথা উল্লেখ করা হয়।
* বি, বি, সি খবরে বলা হয়েছিলো:”…..কলকাতা থেকে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের খবরে প্রকাশ যে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গুপ্ত বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।…”
* দিল্লির দি স্টেটসম্যানের খবর ছিলো: “বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।”
* দি গার্ডিয়ান: গার্ডিয়ানের ২৭শে মার্চ সংখ্যায় এক খবরে বলা হয়, “২৬শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে ভাষণ দেয়ার পরপরই দি ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।”
* নিউইয়র্ক টাইমস এর সংবাদ শিরোনামে বলা হয় ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পর শেখ মুজিব আটক’
* বার্তা সংস্থা এপির একটি খবরে বলা হয় :”ইয়াহিয়া খান পুনরায় মার্শাল ল দেয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।”
* আয়ারল্যান্ডের দি আইরিশ টাইমসের শিরোনাম ছিলো – পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা আর সাথে ছিলো শেখ মুজিবের ছবি।
* দিল্লি থেকে রয়টার্সের খবরে ১০ হাজার মানুষের নিহত হবার ও স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুজিবকে সম্ভবত আটক করা হয়েছে, এমন কথা বলা হয়।
এ ছাড়াও ভারতের বহু সংবাদপত্র এবং ব্রাজিল, ক্যানাডা, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, নেপাল সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের খবরে গুরুত্ব সহকারে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ,যা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়কালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ৩য় খণ্ডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ২৫শে মার্চে মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে এ ঘোষণা দেন তিনি। যা তৎকালীন ইপিআর- এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
ইতিহাসের জলজেন্ত চরম বাস্তবতা বঙ্গবন্ধু প্রদত্ব স্বাধীনতার ঘোষণা। তারই প্রেক্ষিতে মুক্তি যুদ্ধের সূচনা। পরবর্তীতে বেলাল মাহমুদের নেতৃত্বে ২৬শে মার্চ সকালে চট্রগ্রামে কালুরঘাট বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া হয়। পর্যায়ক্রমে কবি আব্দুস সালাম ,আব্দুল্লা আল ফারুক , আবুল কাসেম সন্দীপ ,চট্রগ্রামে আওয়ামীলীগের তৎকালীন সাধরণ সম্পাদক এম এ হান্নান সহ আরো অনেকে সারাদিন ব্যাপী বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণা তাদের নিজের মতো পাঠ করেন। ২৭শে মার্চ বিকাল বেলা কালুরঘাট বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র পাহারা দেয়ার জন্য বিক্ষিপ্ত বাঙালি সেনা সদস্যদের অনুরোধ করলে তারা এখানে অবস্থান নেন । এ অবস্থায় বেলাল মাহমুদ ও অন্যান্যদের অনুরোধে তৎকালীন মেজর, জিয়াউর রহমান সহ ও আরো অনেকে তাদের নিজের মতো করে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন যা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক গণ মাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রচার হতে থাকে।
লেখক :
সাধারণ সম্পাদক , সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী সোসাইটি।
এসোসিয়েটস কোঅর্ডিনেটর ,বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল রিসার্স সেন্টার , যুক্তরাজ্য।
hasibc@gmail.com
Leave a Reply