বৃহস্পতিবার, ০১ জুন ২০২৩, ১০:৪৪ পূর্বাহ্ন

বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আর নেই

ইত্তেফাক
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৩
  • ২২৭ বার
বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ ওষুধ নীতির অন্যতম প্রণেতা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আর নেই। মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি… রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তার মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ও নাগরিক সমাজে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রেস উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু রাত পৌনে ১টায় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ মোহাম্মদপুরে মারকাজুল আল ইসলামীতে নিয়ে গোসলসহ অন্যান্য কার্যক্রম শেষে বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হবে। তার জানাজা ও দাফনের বিষয়ে আজ বুধবার বিস্তারিত জানানো হবে।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দীর্ঘদিন কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। কিছু দিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগেও ভুগছিলেন। গত বুধবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের প্রধান কিডনি বিশেষজ্ঞ ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রধান চিকিত্সক অধ্যাপক মামুন মোস্তাফী মঙ্গলবার রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে  ঘোষণা করেন।

এর আগে গত ৫ এপ্রিল তার শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হয়। এরপর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিন দিনেও অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় রবিবার তার চিকিৎসায় একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মামুন মোস্তফী। অবস্থার অবনতি হওয়ায় জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সোমবার সকালে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর রক্তে ইনফেকশন পাওয়া যায়।

তার শারীরিক অবস্থার উন্নতির জন্য প্রতিদিনের মতো গতকালও সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত মেডিক্যাল বোর্ডের সভা হয়। সভায় প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মামুন মোস্তাফী, মেডিসিনের অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ, নিউরোলজির অধ্যাপক কাজী দ্বীন মোহাম্মদ, মেডিসিনের অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিকী, অধ্যাপক আলী আহসান, কার্ডিওলজির অধ্যাপক আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী, অধ্যাপক শফিকুল বারী ও গণস্বাস্থ্যের চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন। মঙ্গলবার বেলা সোয়া ২টায় ডা. জাফরুল্লাহর কিডনি ডায়ালাইসিস শুরু হয়। সন্ধ্যার দিকে অক্সিজেন স্যাচুরেশনও কমে যায়। আগে চোখ খুললেও গতকাল থেকে চোখ খুলেছেন খুবই কম। বলতে গেলে, অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়েন।

কর্মমুখর জীবন : জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার কোয়েপাড়া গ্রামে। তার বাবা হুমায়ন মোর্শেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা হাছিনা বেগম চৌধুরী ছিলেন গৃহিণী। মা-বাবার ১০ সন্তানের মধ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সবার বড়। ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ভর্তি হন। সেই সময় তিনি বাম রাজনীতিতে যুক্ত হন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৬৪ সালে এমবিবিএম পাশ করে যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেখানে তিনি সাধারণ সার্জারি ও ভাস্কুলার সার্জারিতে প্রশিক্ষণ নেন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলায় বিশেষ ভূমিকা ছিল জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত চিকিৎসকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করা, হাসপাতালের জন্য ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ করার ক্ষেত্রেও তার বড় ভূমিকা ছিল। যাদের আগে কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না এমন নারীরা কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েই হাসপাতালে সেবার কাজ করেছিলেন।

বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের সেই অভিজ্ঞতা জারুল্লাহ চৌধুরী কাজে লাগিয়েছিলেন ১৯৭২ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা যে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভবতা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রমাণ করে।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন ভাস্কুলার সার্জন। তিনি মূলত জনস্বাস্থ্য চিন্তাবিদ। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি দেশকে ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে, ঐ নীতি প্রণয়নের অন্যতম কারিগর ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বহির্বিশ্বে তার পরিচয় বিকল্প ধারার স্বাস্থ্য আন্দোলনের সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জীবনের নানা পর্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার বা সম্মান পেয়েছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ১৯৭৭ সালে তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয় সরকার। ফিলিপাইনের র‍্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে। ১৯৯২ সালে সুইডেন থেকে তাকে দেওয়া হয় রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড। কানাডার ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব ন্যাচারাল মেডিসিন ২০০৯ সালে দেয় ডক্টর অব হিউম্যানিটেরিয়ান উপাধি। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি থেকে ২০১০ সালে দেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ অ্যাওয়ার্ড। যুক্তরাজ্যের প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন ভয়েস ফর গ্লোবাল বাংলাদেশিজ ২০২২ সালে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ‘এনআরবি লিবারেশন ওয়ার হিরো ১৯৭১’ পুরস্কার  দেয়।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনের শেষ বছরগুলোতে জটিল কিডনি রোগে ভুগছিলেন। মানুষ যেন সহজে প্রতিস্থাপনের জন্য কিডনি পেতে পারেন সেজন্য তিনি আইনের পরিবর্তন চেয়েছিলেন। পাশাপাশি তার হাতে গড়ে ওঠা গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ১০০ শয্যার কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট তৈরি করেছিলেন। ঐ ইউনিটে নিজেই ডায়ালাইসিস করাতেন। ইউনিটটি তিনি করেছিলেন কম মূল্যে সাধারণকে মানুষকে সেবার সুযোগ করে দিতে। একটি ক্যানসার হাসপাতাল করার ইচ্ছাও তার ছিল।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2023 DeshPriyo News
Designed By SSD Networks Limited
error: Content is protected !!