রবিবার, ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:৩৩ পূর্বাহ্ন

ভারতে কেউই নিরাপদ নন, দাবানলের মতো ছড়াচ্ছে করোনা

মানবজমিন
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২১
  • ৫১২ বার

রোববার বৃটেনের জনপ্রিয় পত্রিকা ডেইলি মেইলের একটি রিপোর্টের প্রথম লাইন- নো ওয়ান ইন ইন্ডিয়া ইজ সেফ। অর্থাৎ ভারতে কোনো ব্যক্তিই নিরাপদ নন। সেখানে করোনা ভাইরাস যে গতিতে এবং গভীরে প্রবেশ করেছে তাতে এই ভাইরাসের ঝুঁকিকে এড়ানো অসম্ভব। দাবানলের মতো পরিবার থেকে পরিবারে ছড়িয়ে পড়ছে এই রূপান্তরিত করোনা ভাইরাস। মাত্র তিন দিনে সেখানে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মারা যাচ্ছে শিশুরা। মারা যাচ্ছেন অন্তঃসত্ত্বা। হাসপাতালের বাইরে লাশের সারি।

এক ভয়াবহ দৃশ্য চারদিকে। এ রিপোর্টের সঙ্গে প্রমাণ হিসেবে ডেইলি মেইল প্রকাশ করেছে প্রচুর ছবিও। এ ছবি শুধু ভারতের। তাতেই ফুটে উঠেছে ভয়াবহতা কতটা গভীর। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা এখন ভারতে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এলাকা হলো নয়া দিল্লি, মুম্বই, মহারাষ্ট্র। এসব স্থানে হাসপাতালে বেড নেই। অক্সিজেন নেই।

অনেক রোগীকে নিজের প্রাইভেট কারের ভিতর অক্সিজেন নিতে দেখা গেছে। তবে অক্সিজেন সিলিন্ডার গাড়ির বাইরে। এমন পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছেন সাংবাদিক আশীষ শ্রীবাস্তব। ডেইলি মেইলে তার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি মাত্র হাসপাতালে যে পরিমাণ রোগী গিয়েছেন চিকিৎসা নিতে, সেখানে তার চেয়ে ২১ টি সিট কম আছে। ফলে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন অতিরিক্ত রোগী। এক সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছেন।

পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সামরিক বিমান ও ট্রেন ব্যবহার করে অন্য স্থান থেকে অক্সিজেন সরবরাহ দিচ্ছে। দিল্লি হাইকোর্ট শনিবার কড়া ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, অক্সিজেন সরবরাহে কেউ বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে তাকে ফাঁসি দেয়া হবে।

ভারতে করোনা ভাইরাসের প্রথম ঢেউ প্রায় ৬ মাস আগে সামাল দেয়া গিয়েছিল। তখন যুব শ্রেণি খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু এবার ৪০ বছরের নিচে যাদের বয়স তারাও আক্রান্ত হচ্ছে। দুই মাস বয়সী শিশুরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। মারা যাচ্ছেন অন্তঃসত্ত্বা। আর রোগী নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে হাসপাতালগুলো। কোনো কোনো ভিকটিমকে নিয়ে সারাদিন অবস্থান করছে এম্বুলেন্স।

শ্রীবাস্তব লিখেছেন, দিল্লিতে সরকার পরিচালিত বৃহৎ কয়েকটি হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ড পরিদর্শন করেছি আমি। তার মধ্যে অন্যতম গুরু তেজ বাহাদুর হাসপাতাল। সেখানকার কার পার্কিংকে আইসিইউ ওয়ার্ড বানিয়ে ফেলা হয়েছে। করিডোরে স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন রোগী।

প্রতিটি বেডে তিন থেকে চারজন রোগী। তারা সবাই একটিমাত্র অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন। আরো ভয়াবহতা আছে। সবচেয়ে মারাত্মক যাদের অবস্থা তাদেরকে রাখা হয়েছে ভেন্টিলেটরে। সেখানে তারা অক্সিজেন নেয়ার পর তাদের অক্সিজেন লেভেল শতকরা ৯৪ ভাগ। অথচ স্বাভাবিক মাত্রায় এর পরিমাণ শতকরা ৯৫ ভাগ।

অনেক রোগী আছেন অপেক্ষায়। তারা চিকিৎসা পাবেন এমন গ্যারান্টি নেই। ফলে তাদের পরিবারগুলোকে নিজ দায়িত্বে নিজেদের খাবার, ওষুধ ও অক্সিজেন ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। কোনো সরবরাহ আসছে কিনা এ জন্য রাস্তায় বেপরোয়াভাবে লড়াইকরছেন আত্মীয় স্বজনরা।

মানুষজন বলছেন, এই ভাইরাস ভারতের ধনী-গরিব সবাইকে সমান বানিয়ে দিয়েছে। একটি বেড বা একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না অগণিত টাকা দিয়েও। ফলে প্রিয়জন চোখের সামনে হারিয়ে যাচ্ছেন। রাজ্যের রাষ্ট্রীয় পরিচালিত এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থাও প্রায় একই রকম। শ্রীবাস্তব লিখেছেন, সরকারের বাস্তবে কোনো কর্মকা-ে অনুপস্থিতি রয়েছে। পক্ষান্তরে ভারতীয় কর্মকর্তারা একে অন্যকে এই মহামারি এবং এতে সৃষ্ট সঙ্কটের জন্য দায় দিচ্ছেন। ছোট ছোট হাসপাতালগুলো বলছে, তাদের অক্সিজেনের গতি পাল্টে নিয়ে যাচ্ছে বড় বড় হাসপাতালগুলো। আবার কেউ কেউ রোগীদের ¯্রফে বলে দিচ্ছে বাড়ি চলে যান। চিকিৎসা দেয়া যাবে না।

ডাক্তার এবং নার্সরা বলছেন, তাদের জীবদ্দশায় কোনোদিন এই পরিমাণ মানুষকে ইমার্জেন্সিতে আসতে দেখেননি। অনেক সহকর্মী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও বাকিরা টানা তিন থেকে চার শিফটে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের প্রাণশস্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। একটি ওয়ার্ডে প্রতিজন রোগীকে চেক করার জন্য তারা প্রতি এক ঘন্টা পর পর রাউন্ড দেন। কিন্তু এখন রোগী সংখ্যার আধিক্যের জন্য তারা দিনে একবার বা দু’বার ভিজিট করতে পারেন। এক্ষেত্রে রোগীরাও যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না।

শ্রীবাস্তব আরো লিখেছেন, গেটের বাইরে প্রচুর মানুষের ভিড়। তার মধ্যে আছেন সাধারণ মানুষ। কেউ কেউ অসুস্থ। তারা করোনা পরীক্ষা করাতে গিয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে তাদেরকে প্রথমেই করোনা পজেটিভ কিনা তা পরীক্ষা করাতে হবে। ফলে ল্যাবরেটরিগুলো উপচে পড়ছে মানুষে। এসব ল্যাবের বিপুল সংখ্যক স্টাফ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন অথবা বাসায় আইসোলেশনে আছেন।

যেসব ল্যাব দিনে ৫ হাজার পরীক্ষা করতো, তা এখন দিনে ৩৫ হাজার পরীক্ষা করছে। ফলে পরীক্ষার ফল পেতে কয়েকদিন অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। শনিবার আমি একটি বিশাল হাসপাতালের বাইরে তিনজন ব্যক্তিকে মারা যেতে দেখেছি। কারণ, তাদেরকে দেখাশোনা করার কেউই ছিলেন না। তাদের পরিবারের সদস্যরা রোগী রেখে হাসপাতালের গেটে গিয়ে সাহায্য চেয়ে চিৎকার করছিলেন। চিৎকার করতে করতে তারা অনুনয় করছিলেন একজন ডাক্তার যেন গিয়ে তাদের স্বজনকে দেখে আসেন।

পাঁচ সন্তানের পিতা শ্যাম নারায়ণ হাসপাতালে ভর্তি না করা অবস্থায় মারা গেছেন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার মতো অতো অসুস্থ নন বলার ১০ ঘন্টা পরে তার অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়। এ অবস্থায় তার এক ভাই তাকে রিক্সায় করে হাসপাতালে নিয়ে যান। তিনি যখন তাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছেন, ততক্ষণ তার ভাই মারা গেছেন। তার ছোট ভাই রাজ বলেন, সিস্টেম ভেঙে পড়েছে।


শ্রীবাস্তব আরো লিখেছেন, শনিবারের আগের ২৪ ঘন্টায় ভারতে করোনায় মারা গেছেন ২২৬৩ জন। এর মধ্যে কমপক্ষে ৩০০ মানুষ মারা গেছেন নয়া দিল্লিতে। তবু এই সংখ্যা যথেষ্ট নয়। অনেক কমিয়ে দেখা হয়েছে। শ্যাম নারায়ণের মতো যারা মারা গেছেন তারা এই তালিকায় ওঠেন না। কারণ, তিনি মারা গেছেন সামাজিক অবস্থানে। তিনি কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিকে মারা যাননি।

যে পরিমাণ মানুষের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে আগে এমন ভয়াবহতা আর দেখা যায়নি। স্বাভাবিক উপায়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা যাচ্ছে না বলে অনেক স্থানে বৈদ্যুতিক চুল্লিতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে। একবার জ্বালানোর পর কয়েক ঘন্টা এসব চুল্লি বন্ধ রাখা হয় ঠা-া হওয়ার জন্য। তা নাহলে এসব চুল্লি বিস্ফোরণ হতে পারে। অন্যদিকে কবরস্তান লাশে পূর্ণ।

অনেক মৃতদেহ স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় অনেকেই নেতৃত্বের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লোকজনকে পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন, মুখে মাস্ক পরতে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। এর কয়েক ঘন্টা পরেই তাকে দেখা গেছে কয়েক হাজার মানুষের এক রাজনৈতিক র‌্যালিতে। সেখানে মুখে মাস্ক নেই। এ দৃশ্য টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2023 DeshPriyo News
Designed By SSD Networks Limited