সুইজারল্যান্ডের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশি সুলতানা খান, এমন নেক্কারজনক ফেইক নিউজকে ঘিরে চরম বিব্রত ও লজ্জিত দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিরা। কোন প্রকার যাচাই-বাছাই এবং প্রপার চ্যানেলে ক্রসচেক ডাবলচেক ব্যাতিরেকে কতিপয় অপেশাদার ব্যক্তি বিশেষের পাঠানো মিথ্যা ভিত্তিহীন বানোয়াট তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আজগুবি সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন সুইজারল্যান্ড সহ ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশে বসবাসরত সচেতন বাংলাদেশিরা, যারা এতদঞ্চলের দেশগুলোর মূলধারার রাজনীতি তথা মেইনস্ট্রিম পলিটিক্সের কিছুটা হলেও খোঁজখবর রাখেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, যাকে নিয়ে এতো হৈচৈ তিনি নিজেও জানেন না জুরিখে তিনি কী নির্বাচিত হয়েছেন।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, মাত্র ৫০ বছর আগে ভোটের অধিকার পাওয়া সুইজারল্যান্ডের নারীরা আজও অনেক ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষ সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকায় সুইস সরকার নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে সাম্প্রতিক সময়ে। তারই অংশ হিসেবে দেশটির জাতীয় সংসদ (ফেডারেল এসেম্বলি) যাতে বিভিন্ন সুবিধাবঞ্চিত এবং ভিক্টিম নারীদের কল্যাণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, সেজন্য বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের মাধ্যমে ২৪৬ জন নারী প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়া অতি সম্প্রতি সম্পন্ন হয়েছে। ১৪-৩১ মে ২০২১ অনলাইনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাংলাদেশি অধ্যুষিত জুরিখ থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত হন স্থানীয় কমিউনিটির পরিচিত মুখ সুলতানা খান।
উক্ত অনলাইন নির্বাচনে অংশ নেয়ার সর্বনিম্ন বয়সসীমা ছিলো আন্ডার সিক্সটিন অর্থাৎ আগামী ২৯ অক্টোবর ২০২১ তারিখে ১৬ বছর পূর্ণ হবে এমন কিশোরীকেও সুযোগ দেয়া হয় নারী প্রতিনিধি হিসেবে দেশের জন্য কাজ করার। বাংলাদেশি সুলতানা খান সহ যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা চলতি বছর ২৯-৩০ অক্টোবর বিভিন্ন সংস্থার আয়োজনে এবং সুইস জাতীয় সংসদের সহযোগিতায় পার্লামেন্ট ভবনে আয়োজিত ২ দিনের একটি ইভেন্ট অধিবেশনে (অনুষ্ঠানে) অংশ নেবেন। উক্ত ইভেন্টে গণতান্ত্রিক পন্থায় ২৪৬ জন অংশগ্রহণকারী চূড়ান্ত করতেই আয়োজিত হয় নির্বাচন। সংসদের (ফেডারেল এসেম্বলি) দুই কক্ষ ন্যাশনাল কাউন্সিল এবং কাউন্সিল অব স্টেটসেও পরবর্তীতে সীমিত সংখ্যায় তাদেরকে ডাকা হবে শুধুমাত্র নারীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে।
সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী সব সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষরা নিয়ে থাকে, বছরের পর বছর ধরে এমন অভিযোগ দেশটির বিভিন্ন নারী অধিকার সংস্থার। তাদেরকে সন্তুষ্ট করতেই সরকারের উপরোক্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে ২৪৬ জন নারী প্রতিনিধি বা অংশগ্রহণকারী কিন্তু সুইস সরকার নির্বাচন করেনি, করেছে নারী অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন সংস্থা। সুইস পার্লামেন্টের মোট সদস্য সংখ্যাও ২৪৬ জন, তার মধ্যে ন্যাশনাল কাউন্সিলে ২০০ জন এবং কাউন্সিল অব স্টেটসে ৪৬ জন। এই ২৪৬ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। তার পর থেকে নতুন করে এমপি নির্বাচন তথা পার্লামেন্ট ইলেকশনের আদৌ কোন প্রয়োজন পড়েনি আধুনিক বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশ সুইজারল্যান্ডে।
সুইস সংসদের সদস্য সংখ্যার সাথে মিল রেখে ২৪৬ সংখ্যাটি বেছে নেয়া হয় নারী প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে। সংসদে নারী অধিকার বিষয়ক যে সংসদীয় কমিটি আগে থেকেই আছে, তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবেন নারী প্রতিনিধিরা। নারীদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া ও ন্যায্য অধিকার যেমন পেনশন, দারিদ্রতা, ক্যারিয়ার, বেতন এবং ভায়োলেন্স ইস্যুতে সংসদীয় কমিটির সভায়ও সময়ে সময়ে আমন্ত্রণ জানানো হবে নারী প্রতিনিধিদের। ১০টি সংসদীয় কমিটির শুধুমাত্র একটিতেই তারা দাবিদাওয়া পেশ করতে পারবেন। ২০ বছর আগে ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো নারী প্রতিনিধিদের সুযোগ দেয়া হয়েছিলো সংসদে নারী বিষয়ক সুনির্দিষ্ট ইভেন্ট অধিবেশনে যোগ দেয়ার। দীর্ঘদিন পর ২০২১ সালে হতে যাচ্ছে সেটার দ্বিতীয় আয়োজন।
সুলতানা খানের উপরোক্ত অর্জন সুইজারল্যান্ড সহ সমগ্র ইউরোপে বাংলাদেশি নারী সমাজের জন্য অবশ্যই উৎসাহব্যাঞ্জক। বিদেশ বিভুঁইয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করায় অভিনন্দন তিনি প্রাপ্য। কিন্তু নিন্দনীয় বিষয় হচ্ছে, সুলতানা খান যেটা নির্বাচিত হননি সেটাই তার নামের সাথে জুড়ে দিয়ে এমপি হবার মিথ্যা ভিত্তিহীন বানোয়াট এবং অনেকটাই উদ্ভট সংবাদ বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির অধিকাংশ জাতীয় দৈনিক, টেলিভিশন এবং অনলাইন পোর্টালে ফলাও করে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। বিদেশের পার্লামেন্টে সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে আয়োজিত কোন ইভেন্ট অধিবেশনে অংশ নেয়া মানেই যে সংশ্লিষ্ট দেশের এমপি নির্বাচিত হওয়া নয়, তা বোধগম্য হবার সক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশের গণমাধ্যম।
নির্বাচিত নারী প্রতিনিধি সুলতানা খান সুইজারল্যান্ডের মতো দেশে বেগম রোকেয়া হিসেবে আবির্ভূত হবেন এই আশীর্বাদ আমাদের। শুধু তাই নয়, নরওয়ের সায়েরা খান, লন্ডনের রুশনারা আলী, রূপা হক, টিউলিপ সিদ্দিক, আফসানা বেগমের মতো তিনিও একদিন সুইজারল্যান্ডে এমপি নির্বাচিত হয়ে সত্যিসত্যিই ইতিহাস সৃষ্টি করবেন, সেই আশাবাদও আমাদের। কিন্তু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন কিংবা এমপি হয়ে গিয়েছেন এই টাইপের ফেইক নিউজ যারা দেশে বিদেশে প্রকাশ এবং প্রচার করেছে বা করিয়েছে তাদের জন্য শুধুই ধিক্কার। কারণ সুইসের মাটিতে সুলতানা খানের যেটুকু অর্জন সেটাকেও যারপরনাই খাটো করা হয়েছে ভূয়া সংবাদে বাংলা গণমাধ্যমে। সাথে কপি-পেস্ট ট্র্যাজেডি তো আছেই।
Υ?? মাঈনুল ইসলাম নাসিম, সংবাদ বিশ্লেষক।
Leave a Reply