সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০৩:৪৬ পূর্বাহ্ন

স্বজন খুঁজে পেয়েছেন ২২ বছর পর দেশে আসা সেই রেমিটেন্স যোদ্ধা

শরিফুল হাসান
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২০ আগস্ট, ২০২৩
  • ২০৮ বার
শরিফুল হাসানঃ আনন্দের সংবাদ। সবার কাছে কৃতজ্ঞতা। আপনাদের সবার সহযোগিতায় পরিবারের সদস্যরা ২২ বছর পর পেলেন মিজানুর রহমানকে। আপনারা অনেকেই জানেন, দীর্ঘ ২২ বছর পর সৌদি আরব থেকে ফিরলেও পরিবার খুঁজে পাচ্ছিলেন না মিজানুর রহমান‌। এ নিয়ে গতকাল আমি ও আমাদের টিমের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছবি ও পোস্ট দেই।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সেই ছবি দেখে দুবাইতে থাকা তাঁর এক ভাই আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন‌। এরপর তাঁর পরিবারকে জানান। কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে পরিবারের সদস্যরা আসলে পরিচয় নিশ্চিত হয়ে আজ রোববার রাতে ঢাকার আশকোনায় ব্রাকের মাইগ্রেশন সেন্টার থেকে তাকে আমরা পরিবারের কাছে হস্তান্তর করি। এই মুহূর্তগুলোতে আমার চোখ সাধারণত ভিজে যায়। আজও তাই হয়েছে।
আমাদের সব সহকর্মীদের পাশাপাশি এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার জান্নাতুল ফেরদৌস এ সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনিও ভীষণ আপ্লুত ছিলেন। রাতেই মিজানুরকে নিয়ে তাঁর ভাই রেজাউল করিম ও আরেক আত্মীয় আমির হামজা চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন। মিজানুরের বৃদ্ধ মা অপেক্ষায় আছেন ছেলের জন্য। ২২ বছর পর ছেলের সঙ্গে তাঁর দেখা হবে।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সহকারী পুলিশ সুপার জান্নাতুল ফেরদৌস আমাদের জানিয়েছেন, শুক্রবার ১৮ আগষ্ট দুপুর ১২.৩০ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের BG-136 বিমান যোগে ঢাকায় পৌঁছান মিজানুর রহমান। এ সময় তিনি এলোমেলোভাবে ঘুরছিলেন। তিনি স্বজনদের ঠিকানা বলতে পারছিলেন না। কোথায় যাবেন বলতে পারছিলেন না। এ ধরনের ঘটনায় পরিবারের সন্ধান পেতে তারা ব্রাকের সহায়তা নেন। মিজানুর রহমানকে তাঁর পরিবারের খোঁজ করার জন্য বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ শনিবার ভোরে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কাছে হস্তান্তর করেন। আজকে পরিবারের কাছে তাকে ফিরিয়ে দিতে পারায় ব্রাককে ধন্যবাদ জানান তিনি।
আমি এই সুযোগে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ, বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, সিভিল এভিয়েশনসহ আমাদের ব্রাকের সব সহকর্মীদের ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ ঢাকা টিমের নয়ন ভাই, রায়হান, আঁখি, মাহমুদা, নানজীবা, শাকিল, বাকি বিল্লাহ, চট্টগ্রাম টিমের জহিরুল ভাই, মং দাসহ সবাইকে। অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন আপনারা। রাস্তায় পোষ্টার বিলি করা, দুই থানা দুই কাউন্সিলর সবার কাছে যাওয়া, মিজানুর ভাইয়ের যত্ন, কী অসাধারণ পরিশ্রম এরা করে বলে বোঝানো যাবে না। অসাধ্যকে সাধন করে এরা!
আসলে শনিবার সকালে মিজানুর ভাইকে আশকোনায় ব্র্যাকের সেন্টারে আসার পর আমরা দেখি শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ নন। তাঁর বাম পায়ে গভীর ক্ষত। মানসিকভাবে কিছুটা ভারসাম্যহীন। পাসপোর্টে জরুরী যে নম্বর দেওয়া আছে সেই নম্বরে ফোন করে আমরা জেনেছি সেটি পরিবারের কারো নম্বর নয়। চট্রগ্রামের পুলিশকে ছবি ও পাসপোর্টের বিস্তারিত জানাই। পরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছবি ও পাসপোর্ট দিয়ে তাঁর পরিবারের খোঁজ করি। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আমাদের সেই ছবি ও পোস্ট দেখে দুবাই থেকে ওসমান গনি নামে একজন ফোন দিয়ে জানান মিজানুর তাদের ভাই।
পাসপোর্ট অনুযায়ী নাম মো: মিজানুর রহমানের বয়স ৫৭। বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার কোতোয়ালি থানার ১২০ সদরঘাট রোড। পিতার নাম আব্দুল জব্বার, মাতা: ফাতেমা বেগম। পাসপোর্টে চট্রগ্রাম থাকলেও তাঁর বাড়ি আসলে কক্সবাজারের চকরিয়ার বদরখালী গ্রামে। পরিবারের সদস্যরা জানান, মিজানুর রহমান ২০০১ সালে সৌদি আরব যাওয়ার পর থেকে আর কখনোই দেশে আসেনি। তিনি সেখানে গাড়ি চালাতেন। তিনি যে দেশে এসেছেন পরিবারের কেউ জানতো না।‌ ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারেন মিজানুরের কথা।
মিজানুরের আত্মীয় আমির হামজা জানান, দীর্ঘ দুই দশক ধরে মিজানুরের সাথে পরিবারের যোগাযোগ নেই। কখনো দেশে আসেননি। সৌদি আরবে গাড়ি চালাতেন। তাদের বাড়ি চকরিয়ার বদরখালী। ছেলের শোকে মিজানুরের বাবা মারা গেছেন। মা বেঁচে আছেন। তারা ছয় ভাই। মিজানুরকে দেখার জন্য মা অস্থির হয়ে আছেন।
আরেকটা কথা বলি। সরকার বিদেশফরেত মানুষের কল্যাণে রেইজ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ড এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এজন্য সারাদেশে ৩০ টা ওয়েলফেয়ার সেন্টারে করেছে।মিজানুরের মতো মানুষেরা সেই প্রকল্পে সহায়তা পেতে পারেন। আরেকটা কথা প্রবাসীদের জন্য কাজ করতে গিয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয়, সচিব, সিভিল এভিয়েশন, এপিবিএন, ইমিগ্রেশন পুলিশসহ সবার কাছ থেকে যে সহযোগিতা পাই তার কোন তুলনা হয় না। সাধারণ মানুষ আর প্রবাসীদের শক্তির কথা কি বলবো। আপনাদের কারণেই আমরা প্রতিটা ক্ষেত্রে সফল হই। আপনাদের কৃতজ্ঞতা।
মিজানুরকে পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার সময় আমার নিজের চোখও ভিজে যাচ্ছিল। তবে কষ্টে নয় আনন্দে। বিকেলে দেশের বাইরে থেকে ফিরেই এই আনন্দ যজ্ঞের স্বাক্ষী হলাম। যানজটের এই শহরে এই রাতে ভীষণ আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরছি। ২৫ বছর পর দেশে ফেরা ঠিকানাহীন আবুল কাশেমকে পরিবারের কাছে ফিরে দিতে পেরে এমন আনন্দ হয়েছিল।
তবে ঠিকানা থাকার পরেও একজন মানুষ ঠিকানাহীন হবেন এটি ভীষণ বেদনার। মিজানুরের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল। আসলে প্রবাসীদের যেমন স্বজনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা উচিত তেমনি স্বজনদেরও খোঁজ রাখা উচিত। শুধু টাকা নয় ভালোবাসাই আসল শক্তি। এই ভালোবাসার জয় হোক। সবাইকে ভালোবাসা। ভালোবাসা আমার সব সহকর্মীকে। ভালোবাসি বাংলাদেশ।
শরিফুল হাসান

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2023 DeshPriyo News
Designed By SSD Networks Limited