রবিবার, ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:৩৫ পূর্বাহ্ন

৮ই ডিসেম্বর ১৯৭১’র স্মৃতি

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২১
  • ২৬৫ বার
বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজহান চৌধুরীর নেতৃতে ৮ ডিসেম্বর সংলাপ কুমিল্লার আনন্দ শোভাযাএা

শাহজাহান চৌধুরী : ১৯৭১ এর ৭ই ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টা। খুব কাছেই গোলা গুলি শুরু হলো। মনে হলো যেন রাজগঞ্জ ট্রাফিক চৌমুহনি হতেই গুলির শব্দ আসছে। আস্তে আস্তে শহরের চারিদিকে গুলির শব্দ ছড়িয়ে যেতে লাগলো। আজ সকাল থেকে সীমান্তের ওদিক থেকে তেরপাল ঢাকা আর্মীর ট্রাক আসতে লাগলো। কোন কোন ট্রাক থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে রাস্তায়। শহরে সামরিক লোকজন এবং সামরিক যানের চলাচল মনে হয় কিছুটা কম। তখন বুঝিনি প্রিয় স্বাধীনতা এত কাছে, মাত্র একরাতের ব্যবধান।

রাত নটার দিকে খেয়ে দেয়ে চলে গেলাম জহিরের ওখানে শুতে। জহিরের বাসা মানে ওর দুলাভাই বোন ভাগ্নে ভাগ্নিরা ওকে রেখে বাড়ী চলে গেছে। আমাদের বাসা ছিলো টিনের বেড়া, উপরে ছন, তাই বাবা মা আমাকে জহিরের বাসায় থাকতে বলতেন। হক সাহেবের বাসাটি পুরানো আমলের দেয়াল প্রায় ৪৫ ইঞ্চি মোটা। বাবা মার ধারনা শেল পড়লে ছনের ঘরে যে ক্ষতি হবে বিল্ডিংয়ে তা হবে না। তাই তারা তাদের আদরের বড় সন্তানটিকে ঐ বাসায় পাঠাতেন। অন্য ভাইবোনদের নিয়ে তারা ছনের ঘরেই থাকতেন। পিতা মাতা আল্লাহ ও রাসূলের পর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। জহিরের দুলাভাই হক সাহেবের বাসা রাজগঞ্জ ট্রাফিক চৌমুহনি থেকে ইউসুফ স্কুল যেতে রাস্তার ডান পাশে। (বাসাটি আগের অবস্থায় এখনো আছে) কিছুদিন আগে তার উল্টোদিকে শেল পড়ে, আনন্দময়ী কালীবাড়ির সামনে অনেকগুলো দোকন পুড়ে খাঁক হয়ে গেছে। এখন সেখানে পোড়া ভিটা ছাড়া কিছুই নেই। ঐ শেলিং এ কালীবাড়ি পুকুর পাড়ে আজাদ বেকারীতে একজন লোকও মারা গেছে। সেদিন শহরে বেশ ক’জায়গায় শেলিং হয় রাজগঞ্জ, মোগলটুলি, চকবাজার ইউসুফ স্কুল রোডে (যা আমার মুক্তিযুদ্ধের নয়দিনের ঘটনার ডায়রিতে আছে) ঐদিন রাজগঞ্জ বাজার, মোগলটুলি ও অন্যান্য জায়গায় মোট ১৩জন লোক মারা যায়।
৮ই ডিসেম্বর সকালে ঘুম থেকে উঠে জহিরের বাসার রাস্তার দিকের জানালা দিয়ে উকি দিয়ে দেখলাম পোড়া ভিটার উপর, যেখানে সাধান বাবুর মিষ্টির দোকান সেখানে ১টা লাল রঙের জীপ দাঁড়িয়ে আছে। এখানে তিনজনের মিষ্টি দোকান ছিলো। হারান পাল, গৌবীন্দ ঘোষ, সাধন বাবু। এসব মিষ্টি দোকান গুলোর শহরে খুব নাম ডাক ছিলো। তখনকার কুমিল্লার নামী দামি রাজনৈতিক ব্যক্তিগণ এসব দোকানে আড্ডা দিতেন এবং চা মিষ্টি খেতেন। এর কারন হল ইউসুফ হাই স্কুল। এই স্কুলটি কুমিল্লা তথা আশে পাশের অঞ্চলে জিলা স্কুলের পরেই নাম ছিলো। সাধনবাবুর বাকী খাতায় তাহের উদ্দিন ঠাকুরের নাম (স্বাধীনতার পর এমপি মন্ত্রী হন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন) তার নাম আমি নিজের চোখে দেখেছি। যাক গুটি গুটি পায়ে লাল গাড়িটির কাছে এগিয়ে গেলাম, দেখলাম একটি পিস্তলের খাপ, দুটি রাইফেল কিছু গুলি বিক্ষিপ্তভাবে গাড়িতে পড়ে আছে। আর গাড়ীর ডাষ্টবোর্ডে কিছু চকলেট, একটা শ্যাম্পু, সাবান, ব্রাইলী নামে চুলের ক্রীমের একটা কোঁটা, একটা শেভিং ক্রীম, আর টুথ পেষ্ট গাড়ির চাবি পড়েছিলো। দেখতে দেখতে আমাদের পেছনে এসে মহিম (মরহুম) আজাদ, দিলীপ এসে দাঁড়ালো এবং গোলাবারুদ ছাড়া আমরা অন্যান্য জিনিসগুলো ভাগ করে নিলাম। আমরা অনেকে মনে করেছিলাম গাড়ীটি পাক আর্মীর। আমার ভাগে পড়লো চুলের ক্রীম জহিরের শ্যাম্পু। অন্যগুলো আজাদ মহিল দিলীপ নিল। যেহেতু না জানিয়ে এসব নিয়েছি তাই আস্তে আস্তে সবাই কেটে পড়লাম।
বাসায় এসে নাস্তা সেরে আবার বেড়িয়ে পড়লাম। দেখতে পেলাম সবাই এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছে। তখনই আমার মনে হলো সারারাত যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধারা নিশ্চয় ক্ষুর্ধাত। তাদের খাবার দরকার। বাসায় এসে নিজের জমানো ৫০ টাকা নিয়ে আজাদ বেকারী থেকে অনেকগুলো পাউরুটি কিনলাম। বিষয়টি আমার মাথায় আসে মর্নিং শো দেখার ফলে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই আমরা কয়েকজন সেইসময় ইংরেজী সিনেমার পোকা ছিলাম। আমাদের এই ছবি দেখার সুযোগ হয়ে যায় ইয়াহিয়া খানের আই ডি কার্ডের জন্য। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসেই ছাত্রদের জন্য আই ডি কার্ড সিষ্টেম করে দেয়, যা দিয়ে তারা সবকিছুতেই হাফ কনসেশন পেতো। এভাবেই সে সময় লিবারেশন, ডার্টিডজন, গানস অব নেভারন এর মতো ছবি দেখা হয়েছিল। যুদ্ধে বিধ্বস্ত সৈনিকদের খাদ্যের যে প্রয়োজন তা মনে পড়ে যাওয়াতে পাউরুটি নিয়ে ছুটলাম এয়ারপোর্টের দিকে। দারোগাবাড়ী, তালতলা, বড়পুকুর পাড় হয়ে যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম তখন বোধহয় ৮টা কি সাড়ে ৮টা। দেখি লোকে লোকারন্য। আমি রাস্তা পেরিয়ে ব্যাগ নিয়ে তারকাটার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ি এয়ারপোর্টে। এমন সময় দুদিক থেকে দুজন সৈন্য (একজনের মাথায় পাগড়ী) আমার দিকে দৌড়ে আসেন। আমার তো ভয়ে পা মাটির সাথে গেঁথে গেছে, নড়তে চড়তে পারছিনা। শুধু শুনতে পাচ্ছি এই বাচ্চা রোখো রোখো। তারা ২ জন এসে আমাকে দুদিক থেকে ধরে চ্যাং দোলা করে এক জায়গায় নিয়ে বসালো এবং আমার ব্যাগে কি আছে জিজ্ঞেস করলো। আমি তখন ভয়ে পাউরুটি গুলা দেখালাম। আরো কয়েকজন সৈন্য জড়ো হলো। (পরে জেনেছি যাদের মাথায় পাগড়ি তারা হচ্ছে শিখ সৈন্য) আমার রুটি দেখে তারা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে এবং দু একজন পাউরুটি খেতে থাকে। একজন সৈন্য আমাকে বোঝালো তুমি যে এখানে এভাবে ঢুকে পড়েছো, এখানে তো মাইন পোতা আছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে একজন আমাকে পাজাকোলে করে কি একটা যন্ত্র সামনে ধরে তাঁরকাটার বেড়া পার করে দিলো। পেছনে ফিরে দেখি অনেক লোক এ দৃশ্য দেখছে। আমি লজ্জা পেলাম। বেঁচে গেলাম পাড়ার ছেলে মনসুর কে দেখে সে এসেছে এয়ারপোর্টে। দুজনে মিলে টমছমব্রীজের দিকে হাটা দিলাম। আশেপাশে চোখে পড়তে লাগলো মৃত দেহ তবে, বাঙ্গালী রাজাকারদের আনসারদের। এখন যেখানে ইবনে তাইমিয়া স্কুল সেখানে একটা কুয়ার মতো ছিলো। সেই কুয়ায় কয়েকটি লাশ দেখলাম। মানুষ মৃত দেহ গুলোকে ইট ছুড়ে মারছে। কেউ কেউ রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মৃত দেহগুলোকে ইট দিয়ে থেতলে দিচ্ছে। বুঝি এতদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। রাস্তার একটু নিচে একটি মাটির ঘরকে ঘিরে অনেক লোক। শিখ সৈন্যও আছে। সেখানে যেয়ে দেখি অনেকগুলো রাজাকারকে সৈন্যরা ঘরের ভিতর রেখে পাহারা দিচ্ছে। তবুও ফাঁক ফোকর দিয়ে জনতা তাদের খোঁচা দিচ্ছে। তার একটু পিছনে দিঘীর পাড়ে কয়েকটি দোতলা দালান। উৎসুক মানুষের ভিড় দেখে সেখানে যেয়ে দেখি কিছু মিলিশিয়া আর রাজাকার পড়ে আছে। সারা ঘরে মলমূত্র একাকার। বেলা প্রায় ১১টা দিকে ঈদগার ভেতরে দিয়ে বেড়িয়ে আসার পথে একটা আর্মি ট্রাককে উল্টে পড়ে থাকতে দেখলাম।
পাড়ায় এসে দেখি লাল জিপটিকে ঘিরে আমার বন্ধু বান্ধবরা দাঁড়িয়ে আছে। প্রদিপ আমাকে বলল, এই শাহজাহান তুই কই গেছস তোরে আমরা খুঁজতাছি। আমি ভাবলাম যা বাবা আমি যে চুলের ক্রীমটা নিয়েছি এজন্য বোধ হয়। পরে প্রদীপের কথায় ভুল ভাঙলো, সবাই মিলে ঠিক করেছে এই গাড়ীটা নিয়ে আমরা সোনামুড়া যাবো। এখানে একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছিনা ৭১’র এর মার্চ মাসের ২৯ তারিখ কারফিউ শিতিল হলে আমরা পারিবারিকভাবে আমাদের গ্রামের বাড়ি চৌদ্দগ্রাম থানার শিলরী গ্রামে চলে যায়। বাড়িতে ঘুরাঘুরি করছি এপ্রিলের ৪/৫ তারিখের দিকে দেখলাম অনেকে বর্ডার পার হয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে আমি আমার চাচাতো ভাই মহিম একটি দলের সাথে ভারতের একিমপুর হয়ে চোত্তাখোলা বাজারে যায়। সেখানে আমার বড় চাচা ৭০ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের এমপি মীর হোসেন চৌধুরীর দেখা পায়। আমাদের বাড়ি থেকে বর্ডার মাত্র ১৫ মিনিটের পথ প্রায় ১০/১৫দিন সেখানে থাকার পর বড় চাচা মীর হোসেন চৌধুরী আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেন তখন আমাদের বয়স ছিল ১৪/১৫ বছর আর দেখতেও ছোট ছিলাম তখন সেখানে মাত্র সৈন্যবাহিনীর লোকেরা সংগঠিত হয়েছেন। যাক সে আরেক ইতিহাস বাড়ি এসে এপ্রিলের শেষ দিকে আমরা কুমিল্লা চলে আসি। আমাদের পাড়ার এক সিনিয়র ভাই হেলাল পৌরসভার গাড়ি চালায় (কি গাড়ি বললাম না) সে বাসায় গেছে প্যান্ট পড়তে। আমি বাসায় গিয়ে কাপড় বদলিয়ে একটা ক্যাপ পরে আসলাম। ইতিমধ্যে হেলাল ভাই এসে পড়েছে। আমরা এসে আগের অস্ত্র গুলো দেখিনি।
হেলাল ভাই তেল চেক করে বললেন, চকবাজার থেকে তেল নিতে হবে, সবাই ৫ টাকা করে চাঁদা দিতে হবে। আমার প্রায় ১০ জনের একটা দল হুড খোলা লাল জীপে করে রওনা হলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ছাতিপট্টি মসজিদের সামনে গেলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলো। মুক্তিযোদ্ধারা হেলালকে নিয়ে সোনামুড়ার দিকে চলে গেল। প্রায় ১৫/১৬ দিনপর হেলাল একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে আসল। তখন তার কাছে আমরা আর ভিড়তে পারিনি। এক সময় সে কুমিল্লা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কর্মকর্তা হয়েছিল। বিফল মনোরথ হয়ে বাসার এসে খেয়ে দেয়ে আরো কিছু বন্ধু নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে আসলাম এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানেই ঘুরাঘুরি করলাম। পরে জানতে পারলাম শহরে ইতিমধ্যে ডিসি অফিসের সামনে, টাউন হলে, শহরে মিছিল মিটিং হয়েছে।
এতদিন পর এয়ারপোর্টের তাঁরকাটার ভেতরে ঢুকে পড়ার স্মৃতিটা মনে হলে শরীরের সব লোমক‚প দাঁড়িয়ে যায়। কেন্টনমেন্ট মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত দুবেলা যেয়ে বসে থাকতাম ধর্মপুর কুমিল্লা ক্রীমারির সামনে। ওখান থেকে যৌথ বাহিনী কেন্টনমেন্টকে ঘিরে বোমা বর্ষণ করতো। সেখান থেকে একটা মর্টারের গোলার খোলও এনেছিলাম। যা অনেকদিন আমি ফুলদানি হিসাবে ব্যবহার করেছিলাম। সেটা যে কোথায় হারিয়ে গেল। কেন্টনমেন্ট পতনের পর আমার বন্ধু জামাল আর আমি সেখানে সাইকেল নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে মেশিনগানের গুলির একটি খালি বেল্ট লুকিয়ে এনেছিলাম তা আমি অনেকদিন কোমরে বেল্ট হিসাবেও ব্যবহার করেছিলাম। এখনো তা আমার কাছে আছে।
এভাবেই ৮ই ডিসেম্বর ১৯৭১ কুমিল্লা মুক্ত দিবসের প্রথম দিনটি কেটেছিলো।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2023 DeshPriyo News
Designed By SSD Networks Limited