তুহিন মাহামুদ, ইতালি, শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করলো ইতালির মিলানে অবস্হিত বাংলাদেশ কন্স্যুলেট জেনারেল মিলান। দিবসটি পালনের অংশ হিসাবে কনসাল জেনারেল জনাব এম জে এইচ জাবেদ প্রভাতফেরীর মাধ্যমে কনস্যুলেট জেনারেলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে মিলান সেন্ট্রাল স্টেশন সংলগ্ন উন্মুক্ত চত্ত্বরে কনস্যুলেট কর্তৃক অস্থায়ীভাবে স্থাপিত শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন। শ্রদ্ধানিবেদনের এই আয়োজনে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী,ইতালিয় ও অন্যান্য দেশের কয়েকজন নাগরিক অংশগ্রহণ করেন।
দিবসের শুরুতেই একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কনসাল জেনারেল কনস্যুলেট জেনারেলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে অফিস প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করেন। বিকাল চারটায় বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় ZOOM PLATFORM-এ আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে এ পর্ব শুরু হয়। ভাষা শহিদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ দিবস উপলক্ষে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কর্তৃক প্রেরিত বাণী পড়ে শোনানো হয়। অতঃপর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের উপর ভিত্তি করে একটি বিশেষ প্রামান্যচিত্র চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
আলোচনাপর্বে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী অংশ নেন। তাঁরা সকল ভাষা শহিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। সেই সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রতিও বিনম্র শ্রদ্ধা জানান।প্রবাসে বেড়ে ওঠা কোমলমতি শিশুদের মাঝে মাতৃভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের দায়িত্বশীল ভূমিকার কথাও ব্যক্ত করেন।
কনসাল জেনারেল জনাব এম জে এইচ জাবেদ-এর সঞ্চালনায় আলোচনার দ্বিতীয় পর্বে প্রথমে অংশ নেন বলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা লুইজা ব্রুনলি। তিনি বলেন, “মাতৃভাষার মাধ্যমেই একটি শিশু নিজেকে প্রকাশ করতে শেখে এবং তার মস্তিস্ক মাতৃভাষার শিক্ষাই প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করতে পারে”।
জনাব সাজ্জাদ আলী জহির (বীর প্রতীক) তাঁর বক্তব্যে ভাষা আন্দোলনে ক্রমবিকাশের ধারা অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “উর্দুকে ইসলামের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করে এ অঞ্চলের মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলেও সেটা সম্ভব ছিলনা,কেননা উর্দু প্রকৃত অর্থে ইসলামের ভাষা নয়, এটি মূলত: তুর্কি প্রভাবিত একটি ভাষা। তিনি বাংলাদেশ-ইতালির দীর্ঘ কূটনৈতিক সম্পর্কের কথা তুলে ধরে অভ্যাগত ইতালিয় অতিথিদের অনুষ্ঠানে অংশ্রগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানান।
ইউনেস্কো প্রতিনিধি ড. আনতোনেল্লা কাসিজি বহুভাষিক শিক্ষা বিকাশে বিশ্বব্যাপী ইউনেস্কোর কার্যক্রমের কথা তুলে ধরেন। ভাষা শিক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহার এবং প্রাথমিক শিক্ষার বিকাশে মাতৃভাষার অপরিসীম গুরুত্বের কথা তুলে ধরে তিনি সবাইকে মাতৃভাষার বহুল চর্চার আহবান জানান। একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আনয়নে তিনি বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি, এম.পি বলেন, “এই দিবসের অনুপ্রেরণা বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, জাতির পিতার হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশের ইতিহাস চরমভাবে বিকৃত করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে আমরা সঠিক ইতিহাস বিশ্বব্যাপী তুলে ধরতে পারছি। ভাষা আন্দোলনে ছাত্র হত্যাকে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, এর মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপন করা হয়েছে যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বিপুল ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। তিনি আরও বলেন, বাংলা একটি সমৃদ্ধ ও অভিযোজনক্ষম ভাষা, যাতে আট হাজারেরও
বিদেশি শব্দ রয়েছে। ইতালির মত বাংলাদেশেরও সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে যে আড়াই হাজার বছর আগেও এ অঞ্চলে সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। তিনি দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নে প্রবাসীদের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, বর্তমান সরকার তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সচেতন রয়েছে। প্রবাসীদেরকে তাদের সন্তানদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আত্মস্থ করার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন এর মাধ্যমেই তারা প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক নাগরিক হয়ে উঠতে পারবে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি কনসাল জেনারেল জনাব এম জে এইচ জাবেদ বলেন, “বিশ্বায়নের যুগে মাতৃভাষাকে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত রেখেই অন্যান্য ভাষা আয়ত্ব করতে হবে”। সম্মানিত অতিথিদের অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন যে, মিলান কনস্যুলেট ইতালিতে বাংলদেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে অনুরূপ প্রয়াস অব্যাহত রাখবে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, ইতালি ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন বিনির্মানে আগামী দিনগুলোতে সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গঠনমূলক কর্মসূচী বাস্তবায়ন সম্ভবপর হবে।
বিশ্ব মহামারি করোনার বিপর্যস্ত পরিবেশের মধ্যে ভার্সুয়াল এ অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মাধ্যমে প্রবাসে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কোমলমতি শিশুরা নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে নিজেকে ধারণ করতে পারবে এ প্রত্যাশা সকলের।
Leave a Reply