২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের ঘোষণা দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এর পর থেকে শনিবার (৫ মার্চ) পর্যন্ত টানা ১০ দিনের মতো চলছে ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাত। ইউক্রেনে পুতিন আগ্রাসন চালাতে পারেন, এমন শঙ্কায় পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে গত বছরের শেষ দিক থেকে শুরু হয় ‘দৌড়ঝাপ’। এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের শীর্ষ নেতারা রাশিয়ার সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন, দিয়েছিলেন কঠোর হুঁশিয়ারি। শেষপর্যন্ত পশ্চিমাদের এমন উদ্যোগের একটিও পুতিনকে দমাতে পারেনি।
যুদ্ধ শুরুর আগে অন্তত হাফ ডজনের বেশি রাষ্ট্রপ্রধান ইউক্রেনে আগ্রাসন না চালাতে পুতিনকে ফোন করেন। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স ও তুরস্কের মতো দেশগুলো।
এছাড়া ইউক্রেনে হামলার শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত পুতিনের সঙ্গে তিন বার ফোনালাপ করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ফ্রান্সের এই নেতা ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন থামাতে যুদ্ধ শুরুর আগে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছেন। তবে ম্যাক্রোঁর কোনো প্রচেষ্টাই পুতিনকে টলাতে পারেনি। ইউক্রেন নিয়ে শুক্রবার (৪ মার্চ) সর্বশেষ পুতিনের সঙ্গে ফোনে ঘণ্টাব্যাপী কথা বলেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ। তবে, এই ফোনালাপও কোনো ইতিবাচক ফল আনতে পারেনি।
অন্যদিকে যুদ্ধ শুরুর পর বেলারুশে রুশ প্রতিনিধি দল ও ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের মধ্যে দুই দফায় বৈঠক হয়েছে। তাতেও মন গলেনি পুতিনের।
ইউক্রেনে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত দুই অঞ্চল লুহানেস্ক ও দোনেৎস্ককে স্বাধীনতার স্বীকৃতি ও ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করায় রাশিয়ার ওপর ‘নিষেধাজ্ঞা বর্ষণ’ শুরু করে পশিমা দেশগুলো। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইউক্রেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
তবে, এ নিয়ে উল্টো গতকাল শুক্রবার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পুতিন। পশ্চিমাদের সতর্ক করে পুতিন বলেছেন, তার দেশের ওপর আরও বিধিনিষেধ আরোপ করলে পরিস্থিতি বেশি খারাপ হতে পারে।
রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের দেওয়া নানা অবরোধের কারণে ইতোমধ্যে আফ্রিকা থেকে ইউরোপ সবখানেই আঁচ পড়া শুরু হয়েছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের দাম ও মূল্যস্ফীতি বাড়ার মধ্যে দিয়ে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১২০ ডলারে উঠেছে। ২০১২ সালের পর বিশ্ববাজারে তেলের এই দাম সর্বোচ্চ।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে যে দেশটি বেশি মাথা ঘামাচ্ছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই তেলের দাম ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে লক্ষ করা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যারেল প্রতি প্রায় ১১৭ ডলারে উঠেছে।
একইসঙ্গে দেশটির শিকাগোর বাজারে গমের দাম সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে গেছে। সেইসঙ্গে দেশটিতে বেড়ে চলেছে ভুট্টার দাম।
বিশ্বের মোট গম রপ্তানির ৩০ শতাংশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আসে। ভুট্টা আসে এক-পঞ্চমাংশ। এছাড়া এই দুই দেশ থেকে সূর্যমুখী তেলের ৮০ শতাংশ রপ্তানি হয়। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এই দুশ দেশের গমের ওপর নির্ভরশীল। তুরস্ক ও মিশর রাশিয়ার গমের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। ইউক্রেনের পুতিনের আগ্রাসন চালানোর কারণে এসব দেশে ইতোমধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
রপ্তানিকারকদের আশঙ্কা, ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাত দীর্ঘ হলে লিবিয়া, ইয়েমেন ও লেবাননের মত দেশগুলোতে খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়তে থাকবে। একই সঙ্গে এসব দেশে খাদ্য সংকট বাড়িয়ে তুলবে।
এছাড়া রুশ ব্যাংকের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে বিভিন্ন দেশ রপ্তানি সঙ্কটে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে কোন দেশে কার পক্ষ নিবে, কিংবা নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকবে এ নিয়ে অনেক রাষ্ট্রই সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলছে। জাতিসংঘে রাশিয়া-বিরোধী প্রস্তাবে ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ভোট না দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারত ও চীন।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার বিষয়ে পুতিনের বিপক্ষে যায় এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনি চীন। অন্যদিকে ভারতও প্রবল চাপ সত্ত্বেও রাশিয়ার বিরুদ্ধাচরণ ও পুরোপুরি ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াবার নীতি নেয়নি৷
এছাড়া ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পরোক্ষ নীরবতা পালন করছে। তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, ডয়চে ভেলে, আল-জাজিরা।
Leave a Reply