বিশ্ববাজারে জ্বালানী তেল ও গ্যাসের অন্যতম রপ্তানিকারক ইউক্রেনে রুশ হামলা এবং রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞার কারণে তেল-গ্যাসের দাম অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে গেছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় শুধু বাংলাদেশে নয় সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট। প্রতিদিনই বিশ্বব্যাপী বিদ্যুতের সংকট তীব্রতর হচ্ছে। এরই মধ্যে বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতির দেশ জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে প্রায় বন্ধের মুখে শিল্প কলকারখানা, থমকে গেছে অর্থনীতির চাকা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতির দেশ জার্মানিতে জড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকট। দেশটির অর্থমন্ত্রী রোবার্ট হাবেক এই সংকটকে স্মরণকালের অন্যতম আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘রাশিয়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল গ্যাস রপ্তানি কমিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ফের সচল করার উদ্যোগ নিয়েছে তারা।’ বার্লিনে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানিয়েছেন তিনি।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও জাপানে ইয়েনের ভয়াবহ দরপতন, টোকিওতে তীব্র তাপদাহের কারণে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশটি পড়তে যাচ্ছে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ সংকটের মাঝে। দেশটির চাহিদার ৯০ শতাংশ বিদ্যুত আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল ঊর্ধ্বমুখী থাকায় বিশাল অঙ্কের অর্থ পরিশোধে বিপাকে পড়েছে গোটা দেশের অর্থনীতি।
অস্ট্রেলিয়ার স্মরণকালের সবচেয়ে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট সামাল দিতে দেশটির জলবায়ু পরিবর্তন ও শক্তিবিষয়ক মন্ত্রী ক্রিস বাউন জনগণকে সাশ্রয়ী ও সংযমী হওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, সিডনি ও নিউ সাউথ ওয়েলসের বাসিন্দাদের প্রতিদিন সন্ধ্যায় দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। ১৬ জুন পর্যন্ত এই বিধি কার্যকর থাকবে।
গত সপ্তাহে ইকুয়েডরের বিক্ষোভকারীরা এই বার্তাটি দেশটির প্রেসিডেন্টকে দিয়েছিলেন যখন তিনি আশ্বাস দেন, গ্যাস এবং ডিজেলের দাম ১০ সেন্ট কমিয়ে দেয়া হবে। তবে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, এটা যথেষ্ট নয়। জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশটিতে ছড়িয়ে পড়া দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় এই প্রতিশ্রুতি দেন প্রেসিডেন্ট।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি তেলের দাম গ্যালন প্রতি বেড়েছে ৫ ডলার। ভোক্তাদের জীবনযাত্রায় বাড়তি এই বোঝা দেশটির মধ্যবর্তী কংগ্রেস নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাট দলের ওপর প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। অনেক জায়গায় জ্বালানির পেছনে জনগণের খরচ বৃদ্ধির ফলে জনদুর্ভোগ বাড়ার পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে।
পেট্রলচালিত জেনারেটরের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের জ্বালানি না পাওয়ায় নাইজেরিয়ায় অনেক নাপিত চুল কাটতে মোবাইল ফোনের আলো ব্যবহার করছেন। যুক্তরাজ্যে মাঝারি আকারের একটি পরিবার গাড়ির জ্বালানির পেছনে খরচ করতে হচ্ছে ১২৫ ডলার।
হাঙ্গেরিতে বেশির ভাগ জ্বালানির স্টেশনে দিনে ৫০ লিটারের বেশি তেল কিনতে দেয়া হচ্ছে না গাড়িচালকদের। ঘানায় গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশে গত মঙ্গলবার বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেট ছুড়েছে পুলিশ।
অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি পাকিস্তানে বিদ্যুৎ সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সংকট এতোটাই চরমে পৌঁছেছে যে, দেশটির টেলিকম অপারেটররা তাদের মোবাইল এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করার বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে।
বাংলাদেশেও জ্বালানি সংকট, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংস্কারের কারনে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বিদ্যুতের লোডশেডিং মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েকদিন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
পিডিবি চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে। তাছাড়া দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ অনেক কম। এর বাইরে আরও কয়েকটি কারণ আছে। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, সেই কাজ চলছে। ভারত থেকে ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসত, ওদের ওই কেন্দ্রটির সমস্যা হয়েছে ফলে সেটাও আসছে না৷
বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এখন বিদ্যুতের চাহিদা ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে। আর আমাদের যতগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে তার সব মিলিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট। ফলে সবগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে একসঙ্গে উৎপাদনে যেতে হয় না।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহে সংকটের কথা স্বীকার করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তিনি লিখেছেন, ‘গ্যাসের ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহের উন্নতি হলে, বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক হবে। যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও সমস্যায় ফেলেছে। এমন পরিস্থিতিতে আমি সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত।’
ক্যাব সহ-সভাপতি প্রকৌশলী শামসুল আলম বলেন, বিশ্ব বাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বেড়েছে সত্যি। কিন্তু তারা যে ঘাটতির কথা বলছেন, তার সঙ্গে লোডশেডিংয়ের কোন মিল পাওয়া যাচ্ছে না। আসলে সরকার বিতরণ ও রেশনিং ব্যবস্থা ঠিকভাবে করতে পারলে মানুষের এত দুর্ভোগ হওয়ার কথা না।
পেট্রোবাংলা বলছে, দেশে দৈনিক ৪১০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে এ গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব নয় বলে এলএনজি আমদানি শুরু হয় ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে। ব্যয়বহুল এ জ্বালানির দাম বিশ্ববাজারে আরও বেড়েছে। বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ৩৮ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। সর্বশেষ কেনা হয়েছিল ২৫ ডলারে। ফলে দেশে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি ও ব্যবহারের সক্ষমতা থাকলেও তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বর্তমানে খোলা বাজার থেকে এলএনজি কেনা স্থগিত রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে কোন এলাকায় কত সময় লোডশেডিং দেওয়া হবে, তার একটি রুটিন করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লোডশেডিংয়ের বিষয়ে সবার সহযোগিতাও চেয়েছেন তিনি।
Leave a Reply