বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশে সরকার পতনের পর অন্যান্য সরকারি-স্বায়ত্বশাসিত অনেক কার্যালয়ের মতো বিচার বিভাগেও পরিবর্তনের দাবি দেখা গেছে। সম্প্রতি উচ্চ আদালত ঘেরাও করে প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারপতিদের পদত্যাগে বাধ্য করার নজীর রয়েছে। সর্বশেষ বুধবারও এরকম দাবিতে আদালত ঘেরাও করতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশে আদালতের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দাবিতে হাইকোর্ট ঘেরাও, লাঠি মিছিল, প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারপতিদের কক্ষ ভাংচুরের ঘটনাও রয়েছে ইতিহাসে।
পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পাঁচ দিন পরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর’ দাবি করে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারপতিদের পদত্যাগ দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করে। পরে ওইদিনই পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতিসহ ছয় বিচারপতি।
মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের দুই নেতাকে বিচারিক আদালতে হাজির করা হলে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর গত দুই মাসের মধ্যে প্রথম বারের মতো আওয়ামী লীগের আইনজীবীরা আদালতে বিক্ষোভ করেন।
এরপরই রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ফেসবুকে ‘আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট বিচারকদের’ পদত্যাগের দাবিতে বুধবার হাইকোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
অতীতে আওয়ামী লীগ নেতাদেরও আদালতের বিরুদ্ধে লাঠি মিছিল, বিক্ষোভ প্রদর্শনের নজীর রয়েছে।
প্রশ্ন হলো উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাদের অপসারণ বা চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া কী?
বিচারপতিদের অপসারণের নিয়মিত প্রক্রিয়ায় আস্থা না রেখে কেন শিক্ষার্থীরা বা আইনজীবীরা বিচার বিভাগের উপর এ ধরনের চাপ প্রয়োগ করছে? এর ফলে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে কী?
যে প্রেক্ষাপটে আবার ঘেরাও
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর গত দশই অগাস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল কাদেরসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে।
সেদিন শনিবার সকালে ফুলকোর্ট সভা ডেকেছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি।
তবে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রবল প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে সেই সভা বাতিল করা হয়। পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের আরো পাঁচজন বিচারপতি পদত্যাগ করেন।
এরপর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার দুই মাসের বেশি সময় পর আবার আদালতকে ঘিরে কর্মসূচি দেয় শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক এবং ফারুক খানকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকার বিচারিক আদালতে হাজির করা হয়।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দুই মাসে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের আইনজীবীরা আদালতে বিক্ষোভ মিছিল করে।
এরপরই রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ‘আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট বিচারকদের’ পদত্যাগের দাবিতে বুধবার হাইকোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মি. আব্দুল্লাহ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে এক স্ট্যাটাসে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
কমেন্ট সেকশনে তিনি লেখেন, “ যে লীগের হাতে হাজার হাজার ছাত্র ও নাগরিকের রক্ত লেগে আছে, দুই মাস না যেতেই তাদের কিভাবে দুঃসাহস হয় হাইকোর্ট প্রাঙ্গনে খুনি হাসিনার নামে স্লোগান দেওয়ার?”
যদিও আব্দুল্লাহ যে স্লোগানের কথা বলছেন মঙ্গলবার ওই বিক্ষোভ ঢাকার বিচারিক আদালতের (সিএমএম কোর্ট) সামনে হয়।
বুধবার আরেকটি স্ট্যাটাসে আব্দুল্লাহ লেখেন “ ছাত্র-জনতা রাস্তায় ইনসাফ কায়েমের জন্য রক্ত দিবে আর আপনারা আদালতে বিচারকের আসনে বসে জুলুম করবেন?”
বুধবার বেলা ১২টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে জড়ো হয়ে অভিযোগ ওঠা বিচারপতিদের পদত্যাগে দুপুর দুইটা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দেয় আদালত প্রাঙ্গণে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার মনে করেন যে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ‘একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের’ পতন হয়েছে, সেই অভ্যুত্থান সংবিধান বা নিয়ম মেনে হয় নি। নিয়ম কানুনের বাইরে গিয়েই বা চ্যালেঞ্জ করেই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ওই সরকারের পতন ঘটেছে।
সরকার বলেন, “ গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি বিচার বিভাগে আসলে অনেক বেশি স্থবিরতা। স্থবিরতার মূল কারণ আসলে এই যে ফ্যাসিস্ট দালাল যারা আছে তারা থাকার কারণে”।
“এখন তারা যদি থাকে বাংলাদেশের মানুষ ন্যায়বিচার ও পাবে না এবং তাদের কাঁধে ভর করে যে কোন ধরনের ক্যু হওয়ার প্ল্যান বা অবৈধ কাজকে লেজিটিমেট করার প্ল্যান থাকতে পারে। তাই আমরা সে কারণে এটা করেছি। আমরা মনে করি এখানে সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের সবার মতামতের ভিত্তিতেই আমরা এটা করেছি ” বলেন মি. সরকার।
আদালতে আইনজীবীদের কর্মসূচি
উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদাচরণের অভিযোগে বিভিন্ন সময় আইনজীবীরাও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে।
২০০৬ সালে প্রধান বিচারপতির কক্ষের দরজায় লাথি মারা, এজলাস ভাঙচুর করে আইনজীবীরা।
বিভিন্ন সময় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা বিচারপতির বেঞ্চে বিচারিক কার্যক্রমে অংশ না নেয়াসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে আইনজীবীরা।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে গত দুই মাস ধরেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া বিচারপতিদের পদত্যাগ দাবি করে সুপ্রিমকোর্টে আইনজীবীদের মিছিল, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি চলে।
এরই মধ্যে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের কাছে যেসব বিচারপতিদের পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে এমন ৩০ জনের নাম ও অভিযোগ সংবলিত তালিকাও জমা দিয়েছেন আইনজীবীরা।
এসব বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের ফরমায়েশে ফরমায়েশি রায় দেয়া’, ‘সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী বিচার কার্য পরিচালনা করা’ এবং ‘ব্যাপক দুর্নীতির’ অভিযোগ করেছেন আইনজীবীরা।
যদিও এসব অভিযোগের কোন তদন্ত হয়নি বা প্রমাণ হয়নি। তা সত্ত্বেও এই আইনজীবীরা বিচারপতিদের পদত্যাগ দাবি করছেন।
তারা বলছেন বিচার বিভাগ সংস্কারের পূর্ব শর্ত হলো এই বিচারপতিদের পদত্যাগ।
সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মামুন মাহবুব আন্দোলনকারী আইনজীবীদের নেতা।
মাহবুব বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মীমাংসার ফোরাম সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বলবৎ রয়েছে বলে স্বীকার করেন।
তবে, সেখানে অভিযোগ না দিয়ে সরাসরি বিচারপতিদের পদত্যাগ দাবির বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে মি. মাহবুব বলেন, “ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বিচার বিভাগ তো এখন ইনঅ্যাকটিভ হয়ে আছে। বিচার বিভাগকে কার্যকর করতে হলে স্বাধীন বিচার বিভাগ লাগবে”।
“এই অন্তর্বর্তী সরকারও ভুলত্রুটি করতে পারে সে কারণে স্বাধীন বিচার বিভাগ লাগবে। বিশেষ করে হাইকোর্ট ডিভিশনে। যারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারেরও ভুলত্রুটিগুলো রিভিউ করবে, সংশোধনেরও নির্দেশ দেবে। এই বিচারপতিরা থাকলে তারা চেয়ার রক্ষার জন্য ইউনূস সরকারেরও তল্পিবাহক হয়ে যাবে। বিপদটা সেখানেই” বলেন মাহবুব।
যেহেতু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সময়ের ব্যাপার, ফলে এতো সময় দিলে বিচার বিভাগের সংস্কারের কাজ থেমে যাবে বলেও মনে করেন মি. মাহবুব।
এর আগে, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল প্রধান বিচারপতির সাথে সাক্ষাতের পর বলেছিলেন, প্রধান বিচারপতিই ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।
বিচারপতিদের ‘চায়ের আমন্ত্রণ’
এরই মধ্যে জানা যায়, বুধবার হাইকোর্ট বিভাগের ১২ জন বিচারপতিকে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। কয়েকজন বিচারপতি তার সাথে দেখাও করেন।
এক পর্যায়ে বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভুঁইয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের জানান, হাইকোর্টের ১২ জন বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোর্ট পরিচালনার জন্য বেঞ্চ দেয়া হচ্ছে না।
ভুঁইয়া বলেন, “আসলে বিচারপতিদের নিয়োগকর্তা মহামান্য রাষ্ট্রপতি। পদত্যাগ বা অপসারণের সেই উদ্যোগও মহামান্য রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে হয়ে থাকে। এখানে প্রধান বিচারপতির যেটা করণীয় উনি সেটা করেছেন। আপাতত ১২ জন বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোন বেঞ্চ দেয়া হচ্ছে না”।
“বেঞ্চ না দেয়ার অর্থ হলো আগামী ২০ তারিখ কোর্ট খুললে তারা কোন বিচার কার্যে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। আর ওই মামলাটার ( ষোড়শ সংশোধনী) শুনানি আছে ২০ তারিখে। আশা করছি অ্যাটর্নি জেনারেল সেটা প্লেস করবেন। এর মাধ্যমে পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো শুরু হবে” বলে জানান মি. ভুঁইয়া।
একইসাথে মি. ভুঁইয়া আরো জানান, “বিচারপতি অপসারণের সাথে এককভাবে সুপ্রিম কোর্ট জড়িত নয়, রাষ্ট্রপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও জড়িত আছে। আপাতত ১২ জনকে বেঞ্চ দেয়া হচ্ছে না। পরে পর্যায়ক্রমে শুনানির মাধ্যমে বাকিগুলোও আপনাদের সামনে আসবে”।
বিচারপতিদের অপসারণের বিধান সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের রিভিউ আবেদনটি আগামী ২০শে অক্টোবর শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় এক নম্বর ক্রমিকে থাকবে বলে জানান রেজিস্ট্রার জেনারেল।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হুমকিতে?
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলছেন, ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে যে রিভিউ আবেদন করা হয়েছে সেটি গ্রহণ করে রায়ে স্থগিতাদেশ দেয় নি আপিল বিভাগ। ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বলবৎ রয়েছে।
ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে রিটকারীদের পক্ষে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
মি. মোরসেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী একটাই প্রক্রিয়া রয়েছে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে যে কোন অভিযোগ তদন্তের, সেটি হলো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। এটি বলবৎ রয়েছে। এতে আইনগত কোন বাধা নেই”।
কোন বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সেটি তদন্ত করে দেখার নিয়ম রয়েছে। সেই তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে তাকে অপসারণ বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিধান রয়েছে।
শুধুমাত্র অভিযোগের প্রেক্ষিতে কাউকে অপসারণ বা পদত্যাগ যাতে না হয়, সে কারণেই সাংবিধানিক পদগুলোতে এই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান রাখা হয়েছে বলে মনে করেন মি. মোরসেদ।
“বিচার বিভাগ সম্পর্কে ছাত্রদের হয়তো অতটা গভীর অ্যানালিসিস নেই বলে আমি মনে করি। অবশ্য থাকারও কথা না। তারা এখনও কোন প্রফেশনে নেই। কিন্তু তাদের তো নেতারা রয়েছে। তারাই ক্ষমতায় রয়েছেন। তাই আপনার সরকারের কাছে দাবী বলুন। সিস্টেম অনুযায়ী আইন মোতাবেক সবকিছু করা যাবে” বলেন মোরসেদ।
একটি বিভাগের প্রধানের উপর এ ধরনের চাপের ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে না বলে মনে করেন মি. মোরসেদ।
তিনি বলেন, “ বিভিন্ন সময় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। এর ফলে মানুষের আস্থা এমনিতেই কমে গেছে। ফলে ছাত্ররা যদি যথাযথ প্রক্রিয়ায় না গিয়ে এভাবে দাবি করেন তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একেবারেই ঠুনকো হয়ে দাঁড়াবে”।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন ভাবেনি তাদেরও বিচার হতে পারে, ফলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা না নিলে পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে বলে মন্তব্য করেন মি. মোরসেদ।
এদিকে, সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম বিচারপতিদের এভাবে পদত্যাগের দাবি অসাংবিধানিক বলে মন্তব্য করেন।
“ শুধুমাত্র দাবির মুখে কারো পদত্যাগ করা কোন সভ্য সমাজে আইনানুগ নয়” বলেন মি. করিম।
তবে সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্বশীল একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অভ্যুত্থান বা বিপ্লব পরবর্তী সময়ে কোন কিছুই আইন মেনে চলে না।
তিনি বলেন, “ এটা স্বাভাবিক সময় না। অভ্যুত্থান বা বিপ্লবোত্তর সময়ে সবকিছু আইনের চৌহদ্দি মেনে চলে না। এরকম কোন নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। আমরা একটা বিপ্লবোত্তর সময় পার করছি। যেখানে জন আকাঙ্খার কাছে বাংলাদেশে দোর্দন্ড প্রতাপশালী সরকার প্রধান টিকতে পারেন নি”।
“ বিচারপতিদের যারা দুর্নীতি এবং রাজনীতির সাথে জড়িত তাদেরই উচিত ছিল আগে চলে যাওয়া” বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংক্রান্ত একটি বডি এই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল।
কোন বিচারপতি যদি সংবিধান লঙ্ঘন করেন কিংবা অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হন, তাহলে তাকে কিভাবে অপসারণ করা হবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় এই কাউন্সিল।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল।
১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু হলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে সরিয়ে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির হাতে নেয়া হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনকালে সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী এনে সে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে। যার প্রধান হবেন প্রধান বিচারপতি।
এ বিষয়ে ২০১৪ সালে আবার সংবিধানে সংশোধনী আনে আওয়ামী লীগ সরকার।
তখন এ ষোড়শ সংশোধনীতে বলা হয় বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে থাকবে। সংসদে এ সংক্রান্ত বিল পাসের পর ওই বছর সেপ্টেম্বরেই গেজেট প্রকাশ করে সরকার।
সংবিধানের এই সংশোধনীর তীব্র বিরোধিতা করে সে সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং আইনজীবীদের বিভিন্ন সংগঠন।
পরে ওই বছরই হাইকোর্টে এ সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হয়।
২০১৬ সালের পাঁচই মে হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করে রায় দেয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
পরে ২০১৭ সালের তেসরা জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রাখে।
আপিল বিভাগের দেয়া এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্রপক্ষ। আপিল বিভাগে এ আবেদনের শুনানি এখনও অব্যাহত রয়েছে।
‘আদালতকে লক্ষ্য করে কর্মসূচি’
বাংলাদেশের ইতিহাসে বিভিন্ন সময় আদালতের বিভিন্ন রায়, প্রধান বিচারপতি বা বিচারপতিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অসদাচরণসহ নানা অভিযোগে কর্মসূচি পালন করার উদাহরণ রয়েছে।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলগুলোরই নানা দাবিতে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে রাজপথে কর্মসূচি পালনের ইতিহাস রয়েছে।
আইনজীবীরা জানান, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীনই ২০০০ সালে জেল হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে লাঠি মিছিল করা হয়।
২০১৭ সালে বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে দেয়া পর্যবেক্ষণ নিয়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভেদ সৃষ্টি হয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ রায়ের পর আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে নিয়ে বিষোদগার করেছিলেন।
২০১৮ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা বিচারকারী বিচারকদের বিরুদ্ধেও বিএনপি অভিযোগ তুলেছে। সে সময় ওই আদালতকে সাজানো আদালত ও ফরমায়েশি রায় বলে অভিযোগ করেছিল দলটি।
এছাড়া ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এর বৈধতা এবং ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী মিছিল, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচিও পালন করেছিল।