ডয়চে ভেলেঃ পূজার অনুষ্ঠানে ইসলামি গান গাওয়া ৬ জনের বাকি চারজনকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

চট্টগ্রাম নগরের জেএম সেন হল পূজামণ্ডপে ইসলামি গান পরিবেশনের ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা করা হয়েছেG মামলায় পূজা উদযাপন কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (বহিষ্কৃত) সজল দত্তসহ মঞ্চে ইসলামি গান পরিবেশনকারী ছয় শিল্পীকে আসামি করা হয়েছে।

শুক্রবার (১১ অক্টোবর) বিকালে কোতোয়ালি থানায় মামলাটি করেন চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের অর্থ সম্পাদক সুকান্ত মহাজন৷ মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কোতোয়ালি থানার ওসি৷

মামলায় বাকি আসামিরা হলেন গান পরিবেশনকারী চট্টগ্রাম কালচারাল অ্যাকাডেমির সদস্য শহীদুল করিম, নুরুল ইসলাম, আব্দুল্লাহ ইকবাল, রনি, গোলাম মোস্তফা ও মামুন। এর মধ্যে শহীদুল করিম ও নুরুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়েছে৷

তাদের গান পরিবেশন করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও গোলমাল সৃষ্টির অভিযোগে করা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

এর আগে শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার দাবি করেন কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা হয়েছে, তবে দুপুরে সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ডয়চে ভেলেকে বলেন, এ ঘটনায় সেখানে কোনো মামলা হয়নি৷

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জের জে এম সেন হলে শারদীয় দুর্গাপূজাঅনুষ্ঠান মঞ্চে ঘটনাটি ঘটে৷ মঞ্চে সংগীত চলাকালে কয়েক যুবক এসে বলে তারা দেশাত্ববোধক গান গাইবেন। ওই সময় অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা মণ্ডপ কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সজল দত্ত তাদের গান গাওয়ার অনুমতি দেন। কিন্তু দেশাত্মবোধক গান গাওয়ার কথা বললেও মঞ্চে উঠে তারা তা গাননি৷

পরে মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদ ও জে এম সেন হল মণ্ডপ কমিটির সভাপতি আশীষ কুমার ভট্টাচার্য  ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমি এবং সেক্রেটারি অফিস রুমে ছিলাম। ইসলামি গান শুনেই বের হয়ে আসি। পরে তারা চলে যায়। পরে শুনেছি, সজল দত্ত তাদের গান করার অনুমতি দিয়েছে। এ কারণে আমরা সজল দত্তকে মণ্ডপ কমিটি থেকে বহিস্কার করেছি।”

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমি নামের সাংস্কৃতিক সংগঠনের ছয় সদস্য মঞ্চে উঠে দুটি গান পরিবেশন করেন। এর মধ্যে একটি গান ছিল ‘শুধু মুসলমানের লাগি আসেনিকো ইসলাম’। চট্টগ্রামের একজন সাংস্কৃতিক কর্মী শুক্রবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, তার জানা মতে সংগঠনটি জামায়াতে ইসলামি সমর্থিত৷ তিনি বলেন, এতদিন সংগঠনটি ভেতরে ভেতরে কাজ করলেও এখন প্রকাশ্যে এসেছে। পরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জামাত নেতা  বলেন, সংগঠনটি আসলে ইসলামি ছাত্র শিবির-সমর্থিত৷ তবে চট্টগ্রাম মহানগর (উত্তর) ছাত্রশিবিরের সভাপতির দাবি চট্টগ্রাম কালচারেল একাডেমির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই৷

বৃহস্পতিবার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গা পূজার মণ্ডপের অনুষ্ঠানে ইসলামি সংগীত পরিবেশনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এ ঘটনার নিন্দা জানান৷ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম রাতেই পূজামণ্ডপটিতে যান। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের আশ্বাসও দেন তিনি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া প্রায় তিন মিনিটের এই ভিডিওটিতে দেখা যায়, ছয়জন তরুণ মঞ্চে গান পরিবেশন করছেন। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) রইছ উদ্দিন শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “পূজা উদযাপন কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সজল দত্তের আমন্ত্রণে মণ্ডপের অনুষ্ঠান মঞ্চে চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির ছয়জন শিল্পী গান গেয়েছিলেন। সেই গানের কিছু কথা উপস্থিত মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করেছে। এই ঘটনায় গতকাল রাতে অভিযান চালিয়ে দু’জনকে আটক করা হয়। বাকিদেরও আটক করা হবে। আটক দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঘটনার পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল কিনা, পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে। এই ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করার প্রক্রিয়া চলছে।”

তবে  চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল- পুলিশ এমন দাবি করলেও মণ্ডপ কমিটির সভাপতি আশীষ কুমার ভট্টাচার্য জানিয়েছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, “তারাই অনুষ্ঠানস্থলে এসে গান পরিবেশনের আগ্রহ দেখিয়েছে, যেটা সেখানে উপস্থিত সবাই দেখেছেন। আমরা তাদের কোনো আমন্ত্রণ করিনি। সজল দত্ত তাদের গান করার অনুমতি দিয়েছেন- এটা সত্যি। সে কারণেই আমরা তাকে বহিস্কার করেছি।” তবে পুলিশ কর্মকর্তা রইছ উদ্দিন বলেন, “পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য মণ্ডপ কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সজল দত্তকে খোঁজা হচ্ছে। তবে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে পেলেই আসল সত্যিটা জানা যাবে।”

আটক দু’জন হলেন চট্টগ্রামের তানজিমুল উম্মাহ মাদ্রাসার শিক্ষক শহীদুল করিম ও দারুল ইরফান একাডেমির শিক্ষক নুরুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার রাতে নগরের পৃথক স্থান থেকে এই দু’জনকে আটক করা হয়। মঞ্চে তাদের সঙ্গে আর যারা ইসলামি গান গেয়েছিলেন তারা হলেন  আব্দুল্লাহ ইকবাল, রনি, গোলাম মোস্তফা ও মো. মামুন।

শুক্রবার পুলিশ কর্মকর্তা রইছ উদ্দিন আরো বলেন, আটক দু’জনের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। পূজা মণ্ডপের অনুষ্ঠানে ইসলামি সংগীত পরিবেশন করা অন্য চারজনের নাম জানালেও তাদের সম্পর্কে আর কোনো তথ্য জানায়নি পুলিশ।

চট্টগ্রাম মহানগর (উত্তর) ছাত্রশিবিরের সভাপতি ফখরুল ইসলাম ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেছেন, গ্রেপ্তারকৃতদের সঙ্গে শিবিরের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে জামায়েতে ইসলামীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমি ইসলামী ছাত্র শিবির-সমর্থিত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন।

মণ্ডপ কমিটির সভাপতি আশীষ কুমার ভট্টাচার্য বলেন, “এই ধরনের কাজে আমরা খুবই কষ্ট পেয়েছি। পূজারিরাও অনেক কষ্ট পেয়েছেন। সারা দেশে আমাদের অনেক সংগঠন আছে, তারাও অনেক কষ্ট পেয়েছেন, ব্যথিত হয়েছেন।”

বৃহস্পতিবার পূজামণ্ডপে ইসলামি সংগীত পরিবেশনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে যান চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “খবর শুনেই আমি দ্রুত সেখানে ছুটে গেছি। গত এক সপ্তাহ ধরে পূজা নির্বিঘ্ন করতে আমরা দিন-রাত কাজ করছি। এর মধ্যে এমন একটি ঘটনা ঘটে গেল। আমি ওই মণ্ডপ কমিটির সবার সঙ্গে কথা বলে তাদের আশ্বস্ত করেছি। অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আশ্বাস দিয়েছি। সেখানে সিসিটিভি আছে। এদের চিহ্নিত করা কঠিন কিছু না। পরিস্থিতি এখন শান্ত।”

মামলা কি হয়েছে আদৌ?

চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কাজী মোহাম্মদ তারেক আজিজ শুক্রবার সকালে বলেছেন, এই ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা হয়েছে। তবে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনির হোসেন শুক্রবার দুপুরে ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এই ঘটনায় এখনও কোনো মামলা হয়নি। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।”

Leave A Reply

আমাদের সম্পর্কে

যোগাযোগ ও আমাদের সম্পর্কে

All rights reserved by Desh Priyo News | Design and Developed by Sudipta Acharjee

Exit mobile version