রাষ্ট্র সংস্কারের দাবী অনেকদিনের। সময় ও সুযোগে এ দাবী বহুবার উঠেছে ও জোরালো হয়েছে। ৮ আগষ্ট বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের জন- আকাক্সক্ষার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করেছেন। তারা কাজ শুরু করেছেন। ভালো দিক হচ্ছে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা এসব সেক্টরে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলছেন। বিভিন্ন সংস্কার দাবীতেও তারা স্বোচ্চার ছিলেন।
এসব কমিশন কি করবে। গণমুখী কিছু সুপারিশ করবে। এসব সুপারিশ কারা বাস্তবায়ন করবে। সরকারের আমলা-কর্মচারীরা। তারা এসব সুপারিশ নিজের পছন্দ অনুযায়ী সংস্কার করে বাস্তবায়ন করবে না, এমন গ্যারান্টি কই। অতীতে গনমুখী অনেক ব্যবস্থার সুফলই জনগন পায়নি, সেসব বিদ্যমান থাকা সত্বেও। এখনও জনপ্রশাসনসহ সব সেক্টরে স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগীরা রয়েছেন। অনুগতরা বিশৃঙ্খল ও সংখ্যালঘু। সরাসরি কোন রাজনৈতিক দল এখন ক্ষমতায় নেই। সংস্কার- সুপারিশ বাস্তবায়ন করার প্রথম কাজই হলো প্রশাসন থেকে শুরু করে সববিভাগে নতুন সরকারের অনুগত লোকবল থাকা। অনুগত বলতে রাজনৈতিক আনুগত্য, সরাসরি দলীয় নয়। যার কাজ চলছে, দীর্ঘ বঞ্চিতদের প্রমোশন- পদায়ন। বিরোধী মত দমনের নামে ক্রসফায়ার, হত্যা, গুম, মামলা, নিপীড়ন, নির্যাতন, চাকরি- প্রমোশন- ভালো পদায়ন সবকিছু থেকেই বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল। সর্বোপরি মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার কেড়ে নিয়ে বৈষম্যের শিকার করে রাখা হয়েছিল। তাই মানুষ শুধু হাসিনাকে সরাতে চায়নি, যে দলের সমর্থনে তিনি স্বৈরাচার হয়েছেন, তার বিষয়েও প্রশ্ন এসেছে। তিনি ভোট থেকে শুরু করে সবব্যবস্থা কিভাবে কুক্ষিগত ও ধ্বংস করেছেন, তা রোধেই পদক্ষেপ বা সুপারিশ আসবে, সাথে থাকবে ছাত্র- জনতার গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা মানে নতুন ভাবনা- চিন্তা, আধুনিকায়ন। যেখানে প্রধান লক্ষ্য জনগণের কল্যান, বাস্তবায়ন সুফল পেলে-তখনই রাষ্ট্রের পরিচয় দাঁড়াবে কল্যানকর রাষ্ট্র হিসেবে, এটাই মানুষের চাওয়া।
সংস্কার বা পরিবর্তন তখনই সফলতা পায় যখন ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী তথা রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও আমলা- কর্মচারী সবার এক চিন্তা- চেতনা থাকে। এক রকম করে ভাবা, কমন আন্ডারষ্টেন্ডিং। এর জন্য ইস্যুভিত্তিক জন- আকাক্সক্ষা স্পষ্ট হওয়া দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোই সভা- সমাবেশের মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত করে এমন গণ- আকাক্সক্ষা তৈরি করে। যা অধিকাংশ সাধারণ মানুষ তার চেতনায় লালন করে। ওটাই রাজনৈতিক চেতনা। সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা এভাবেই রাষ্ট্রে প্রতিফলিত হয়। তখনই রাষ্ট্র জনগণের হয়ে ওঠে।
কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ভিন্ন ও মৌলিক জায়গায়। বিএনপি ও জামাত কি ছাত্র- জনতার গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী দল। এনিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে, পরস্পর বিরোধী বক্তব্য রয়েছে, বির্তক চলমান। হয়তো উদ্দেশ্য এক ছিল। আন্দোলনকারী দল ছিল তারাও। কিন্তু ফলাফল বা সফলতায় সরাসরি তাদের নেতৃত্ব ও দলীয় অংশগ্রহণ কতটুকু ছিল তা কেউই স্পষ্ট করছে না। তবে গণ- অভ্যুথানের সুফল ভোগকারী দল হচ্ছে বিএনপি, জামাত ও সমমনারা এটা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। এখন তাদের মধ্যে ঐক্য বা মতভেদ কেমন প্রভাব ফেলতে পারে তা ভবিষ্যতই বলবে।
আসলে মানুষ চায় এত দিনের অবিচারের বিচার। তাদের চাহিদার বাস্তবায়নই হবে সবচেয়ে বড় সংস্কার।
রাজনৈতিক দলই স্বৈরাচার তৈরি করে। এ থেকে মুক্তিও আনে অন্য রাজনৈতিক দলই। যদিও এবারের গণঅভ্যুত্থান কিছুটা ব্যতিক্রম ও স্বতন্ত্র ধারার বিকাশ ঘটিয়েছে। বিষয়টা কিন্তু রাজনৈতিক, তাই তার চরিত্রকে সেভাবেই ব্যাখ্যা করতে। ভিন্নতা ভিন্ন ব্যাখ্যায় উপস্থাপিত হলে সঠিকতা হারিয়ে যায়।
তাই প্রয়োজন রাজনৈতিক দল সংস্কার। যার জন্যে অবশ্য রাষ্ট্রের কাঠামোগত প্রতিষ্ঠানগুলোরও সংস্কার দরকার। আর ব্যক্তির সংস্কারও একই সূত্রগাঁথা। বিষয়টা সামষ্টিক, ব্যক্তিগত নয়। ব্যক্তি বলতে তার স্বভাব- চরিত্র, এ জন্যেই নিয়ম- শৃঙ্খলা। যা এক এক করে সবাইকে সামষ্টিক বা গোষ্ঠীবদ্ধ করে।
এবার একটা নতুন প্রেক্ষাপটের জন্ম ঘটেছে। তা হলো তরুন প্রজন্ম, তাদের নেতৃত্ব। কাঠামোবদ্ধতায় অনেকেই ক্ষণস্থায়ী ও দুর্বল ভাবছেন। তাদের জন-অংশগ্রহণ ক্ষমতাই ছিল এ অভ্যুত্থানের সফলতা। যা অন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সংগঠন থাকার পরও বার বার ব্যর্থ হচ্ছিল। এসব ভাববার বিষয়।
রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয় এবং ভোট লুট বন্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবী তুলেছে। সমমনা দলগুলোরও একই মত। এসবই মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কার। তবে দলপ্রধান ও সরকার প্রধান একই ব্যক্তি থাকবেন কিনা এ নিয়ে কোন দলই মুখ খোলেনি। বিএনপি বাড়িয়ে দেশ পরিচালনায় দলীয় মত জাতীয় সরকারের কথা বলেছে। এর কাঠামো, পরিচালনা বিস্তারিত কিছুই এখনও বলে নি। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থার কথাও বলেছে বিএনপি। যারও বিস্তারিত বলে নি।
আমরা দেখেছি সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর। একই ব্যক্তি যতবার খুশি ততবারই প্রধানমন্ত্রী। তিনি যা চান হয়, চান না হয় না। তাই সব তার দয়া ও অনুগ্রহে হচ্ছে এমন প্রকাশেই রাষ্ট্র অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতার খবর পড়তে পড়তে মানুষ বিরক্ত ছিল। ক্ষমতার ভারসাম্য প্রয়োজন। এককেন্দ্রিকতার বদলে বিকেন্দ্রীকরণ দরকার সবকিছুতে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারকে জবাবদিহিতায় অভ্যস্থ থাকতে বাধ্য রাখতে হবে- এটাই জনগণের কাছে জবাবদিহিতা। দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রীত্ব নয়। সংবিধান সংস্কার লাগবে।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে পুরো সংসদ জিম্মি। এমপিরা থানা- পুলিশ থেকে স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন কাজের ভাগ- বাটোয়ারা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজিসহ নিজ এলাকার বিচার-সালিশ থেকে শুরু করে সবধরনের কাজ তাদের ছাড়া হতোই না। না জানিয়ে করলে কর্মকর্তাদের শাস্তি ভোগ করতে হতো। এমপিদের এলাকার অভিভাবক বলা হতো। এতে শাসনব্যবস্থা এমপিদের কাছে নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছিল। নিজ দলও তাদের কাছে কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল। দুইবারের বেশি এমপি নয় এবং আইন তৈরি ছাড়া তারা কোন কাজে জড়ালে শাস্তিযোগ্য অপরাধ এমন বিধান দরকার। সংসদকে জনগণের কাছে জবাবদিহিতায় বাধ্য রাখতে হবে।
একভোট বেশি পেলেই এমপি হয়ে যান। এতে পরাজিতের সব ভোট নষ্ট হয়ে যায়। প্রাপ্ত সব ভোটেরই (বিজয়ী- পরাজিত) মূল্যায়ন হলে ভালো। সবদলের সারা দেশে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন বন্টন ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। যাদের ভোট সেভাবে নেই, সংখ্যায় কম তাদের প্রতিনিধিও সংসদে থাকলে, ওই সংসদ সবার হবে। এমন সর্বজনীন সংসদ সবাই চায়। ভাবা যেতে পারে।
বর্তমান ব্যবস্থায় প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক আইন সবই গণবিরোধী, একে জনবান্ধন করা। প্রশাসক বাহাদুরদের জনসেবক হতে বাধ্য করা। পুলিশের আইন হিংস্র, দানবিক ও অপরাধী- বান্ধব। পুলিশকে মানবিক হতে বাধ্য করার আইনী ব্যবস্থা দরকার। বিচারব্যবস্থাকে বন্দী করে ফেলার বিদ্যমান সবব্যবস্থাই বাতিলযোগ্য।
উৎপাদন বিরোধিতার বিপরীতে উৎপাদন ও বিনিয়োগ বান্ধব, লুটপাট ও পাচার বন্ধ, পরিবেশ বিধ্বংসী নয়, জাতীয় সম্পদের আত্মসাতকারীর বিপরীতে কর্মসংস্থানমুখী অর্থনীতি এবং বিনিয়োগের সুরক্ষা দিয়ে বাইরের পুঁজি দেশে আনার স্ব- নির্ভর অর্থনীতি দরকার।
একস্তর বিশিষ্ট সরকার ব্যবস্থায় চেয়ারম্যান- মেম্বারগণ জনগণের বদলে এমপিদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলেন। দুই স্তর-কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা হলে মন্ত্রী- এমপিরা কেন্দ্রীয় সরকারে থাকবেন। স্থানীয় সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি হতে বাধ্য।
মৌলিক অধিকারগুলো ফাঁকি, অকার্যকর ও শর্তে শৃঙ্খলে বন্দি। এগুলো নিঃশর্ত ও অলঙ্ঘনীয় হওয়া দরকার।
কবে নাগাদ সংস্কারের সুফল ভোগ করবে জনগণ। এখন বলা হচ্ছে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিশনগুলো প্রতিবেদন- সুপারিশ জানাবে। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সবার সাথে আলোচনা শুরু করবে- জনঅংশগ্রহণ। এরপর সংশোধন, চূড়ান্ত। তারপর অগ্রাধিকারগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন। বেশ সময়সাপেক্ষ। এই সরকারের মেয়াদে কাজটার অগ্রাধিকার বাস্তবায়ন শুরু হবে এমন একটা রোডম্যাপের আভাস মিলছে। এছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ও সংস্কারে পৃথক কমিটি ও কমিশন করেছে প্রয়োজনানুসারে।
রাষ্ট্র সংস্কার কাজটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ও কঠিন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারকে তা বাস্তবায়ন শুরু করে যেতেই হবে। এটাই পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা।
মাসুক আলতাফ চৌধুরীঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।