মাসুক আলতাফ চৌধুরী
শুনলেই গা শিউরে ওঠে। কিন্তু এমনটাইতো ঘটছে অহরহ।
পুরো দেশের একই চিত্র। যেখানে ইজিবাইক বা ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা- ভ্যান বেশি চলে সেখানে এমন লোমহর্ষক ঘটনাও বেশি। গরীব এলাকায় উপদ্রব আরও বেশি। অটো চালক-মালিকরা আতংকে আছেন। কারণ শুধু ছিনতাই হলে চলতো, সাথে জীবনও দিতে হচ্ছে তাদেরই। আমাদের নাগরিক ও ব্যক্তি নিরাপত্তা এখনও কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে একটা বাস্তব চিত্র এটি।
গেল মে মাসের শেষ সপ্তাহে কুমিল্লা লাকসামে চালককে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। প্রায় একই সময়ে কুমিল্লা নগরীর টিক্কাচরে চেতনা নাশক ওষুধ খাইয়ে চালককে খুনের পর অটো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।
ছিনতাইয়ের প্রধান টার্গেট অটোরিকশা- ভ্যান, কেন। অটো রেজিষ্ট্রেশন হয় না- লাইসেন্স মেলে না। আইনত মালিক হওয়া যায় না। এটা কেমন যান বা বাহন তা মোটরযান আইনে বলা নেই। পায়ে চালানো রিকশা, ডিজেল- তেলে চলা যানের কথা বলা আছে, কিন্তু নেই ব্যাটারী- বিদ্যুৎ চালিত রিকশা বা যানের কথা। নামে অটো, সংজ্ঞায় কোন ধরনের যান হবে তা নিয়ে জটিলতা। এই সুযোগে যার কাছে থাকবে, মালিক বনে যায় সে। এই সুবিধা ছিনতাইয়ের প্রধান টার্গেটে পরিনত করেছে অটোরিকশাকে। অবৈধ বাহন হলেও চলছে। গরীব অদক্ষ চালকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাই চলাচলে তেমন কঠোরতা নেই। একই কারণে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন চালককে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে পারে না, পায়ে চালানো রিকশা চালকের মতো। এতে পরিচয় সনাক্ত কঠিন হয়ে যায়।
সামান্য ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা ছিনতাই করতে চালককে খুন করতে হয় কেন। কেন খুন লাগে। কারণ চালক ছিনতাইকারীদের দেখছে, পরে দেখে ফেললে চিনে ফেলবে। আর তাই খুন করে ফেললেই কর্ম শেষ। যাত্রী বেশে ওঠা ছিনতাইকারীরাই ঘটনা ঘটায়। এরা একাধিক হয়, তিন- চারজনের সংঘবদ্ধ চক্র। কতগুলো ছিনতাই, খুনের ঘটনা ঘটেছে তার সঠিক তথ্য পর্যন্ত নেই কারো কাছে।
ছিনতাই যারা করে তারা সাধারণত ছিঁচকে অপরাধী। চুরি, ছিনতাই এসব চলছে, চলবে। পাশাপাশি পুলিশী ধরপাকড়ও চলছে, চলবে- এ যেন রুটিন ওয়ার্ক। ছিনতাইকারীদের প্রায় সবাই নেশাখোর, সহজলভ্য সাধারণ কমদামি নেশায় আসক্ত। এরা হুটহাট করে সব করে। নেশা জোগার করতেই তৎপর থাকে। অপরাধ করে ফেলতে ইচ্ছে করে, করে ফেলে। একটার সাফল্য আরও বড় অপরাধে উৎসাহিত করে। এক ধরনের অপরাধ করা না গেলে আরেকটা -অন্য ধরনের শুরু করে। এরা বসে থাকার লোক নয়। এটি বেকার-অলস গরীব কর্মহীন বখাটে কিশোর-যুবদের একটা প্রবণতা। কিন্তু তাই বলে শুধুমাত্র ছিনতাই করতেই, সাথে করতে হচ্ছে খুনের মত মারাত্মক অপরাধ।
কেমন করে ছিনতাই হয়। এর উত্তর এরিমধ্যে মিলেছে যাত্রী বেশে। বিস্কুট- ড্রিংক খাবারের সাথে চেতনা নাশক মিশিয়ে চালককে সংজ্ঞাহীন করে নির্জন সড়কের পাশে ফেলে রেখে অটো নিয়ে পালিয়ে যায় এরা। চালক জোর খাটালে চলে ধারালো দেশিয় অস্ত্রে জখম, গলা কেটে বা কুপিয়ে খুন। না হলে কোন কিছু পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে বা গলা টিপে খুন। আরও নির্মম ঘটনাও ঘটে। পুলিশের হাতে কুমিল্লায় সম্প্রতি আটক হওয়া চক্রের সদস্যরা অচেতন চালককে সড়ক-মহাসড়কে ভারী যান-বাহনের নীচে ফেলে খুন করার কথা স্বীকার করেছে। চালক খুন হলে খবর রটে, সংবাদ হয়, হত্যা মামলা হয়, পুলিশী তৎপরতা বাড়ে। শুধু অটো ছিনতাই হলে – চালক বেঁচে গেলে পুলিশী গুরুত্ব মেলে না এই অভিযোগ ভুক্তভোগী ছিনতাই হওয়া অটো চালক- মালিকদের। ছিনতাইকারীরা অটো চালকদের গরীব সাধারণ মনে করে খুন করে ফেলে। এটাও অন্যতম কারণ।
অনেক শহরেই পরদেশি- অন্যজেলার শ্রমিকরা অনন্যোপায় হয়ে অটো চালায়। আগের পায়ে চালানো রিকশা চালকের মতো। কুমিল্লা তেমনি এক জেলা। রংপুর বা উত্তরবঙ্গ বা পিছিয়ে থাকা ওই সব অঞ্চলের অটোচালকের কাছে কুমিল্লা সৌদিআরব। ভাড়া বেশি, আয় বেশি। থাকা- খাওয়া গ্যারেজ মালিকের। পুঁজি, দক্ষতা কিছুই লাগে না। এরা ভাসমান। একজেলার মানুষ জীবিকার তাগিদে আরেক জেলায়। এই বৈষম্যও ছিনতাইয়ের অন্যতম টার্গেট। ঠিকানাহীন মনে করে চালককে মেরে ফেলে সড়কের পাশে, ডোবায়, খাদে, ক্ষেতে ফেলে অটো নিয়ে চলে যায় ছিনতাইকারীরা।
অবশ্য এখন দু- এক দিনের পঁচা- গলা লাশেরও ফিঙ্গার প্রিন্ট মেলে। চেহারা ও লাশ দেখে চেনা না গেলেও, রিডার পরিচয় সনাক্ত করে। এনআইডির প্রযুক্তিগত এমন ব্যবহার লাশের পরিচয় সনাক্তে দারুণ কাজে লাগছে। লাশের পরিচয় না মিললে খুনের ঘটনা অপমৃত্যুতে হারিয়ে যেত। আগে এমনই হতো। এখন তাই এমন অপরাধে পাড় পাওয়া যাচ্ছে না সহজে। অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা দিন দিনই কমে আসছে।
চুরি-ছিনতাইয়েরও মৌসুম আছে, সময়ে সময়ে বাড়ে। যেমন ঈদের মৌসুম। এমন অপরাধ ঠেকাতে পুলিশের টহল জোরদার- বাড়ানোর কথাই আসে। পুলিশের টহল কখনও বন্ধ থাকে না। তারপরও এমন অপরাধ যেন খৈ- মুড়ি খাওয়ার মতো সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এর সংখ্যাধিক্য উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু সচেতনতা দিয়ে একে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। প্রান্তিক ওই পর্যায়ে সচেতনতাও খুব কার্যকর হচ্ছে না। সিএনজি অটোরিকশাও এমন ছিনতাই ও খুনের টার্গেটে পরিণত হয়েছিল। চালক লোহার খাঁচায় নিজেকে নিরাপদ করে এখন চলাচল করছেন, এতে রক্ষা মিলেছে। যা অটোতে সম্ভব নয়।
সিএনজির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রেজিষ্ট্রেশন বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন, এখন পাওয়া গেলেও সহজ নয়। তবুও স্বস্তি ফিরেছে।ছিনতাই, খুন কমেছে। ব্যাটারী চালিত অটোরিকশার রেজিষ্ট্রেশন- লাইসেন্স নিয়েও ঝামেলা চলছে দীর্ঘদিন, দেয়াই শুরু হয় নি। কেউ সুরাহা করছে না। যার কারণে এই দুই যানই- বিশেষ করে অটোরিকশা অনিরাপদ, চালকের মৃত্যু ঝুঁকির বড় কারণ। তাহলে রেজিষ্ট্রেশনের ঝামেলা চুকিয়ে ফেললেইতো হলো। কেন করা যাচ্ছে না, আর কত জীবন শেষ হলে কর্তৃপক্ষের নজরে আসবে।
সড়কে দুইধরণের অটোরিকশা চলে। বড় এবং ছোট- মিশুক। বড়গুলো ছিনতাই টার্গেটের প্রথম পছন্দ । বেশিরভাগই চায়না আমদানির, ব্যাটারী বেশি লাগে, দামও বেশি। পাবলিক পরিবহনের মতো, ভাড়াও কম লাগে। বড়গুলোর অধিকাংশ শহরে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, কুমিল্লা নগরেও কম চলে। বড়গুলোর জায়গা দখল করেছে ছোট- মিশুক। তাই বড়গুলো শহরের আশ- পাশে চলাচল করে, যা ছিনতাইকারীদের জন্যে অনেকটা নিরাপদ এলাকা। সাধারণের সাথে যাত্রী বেশে ছিনতাইকারীদল সহজে চড়তে পারে, সন্দেহ এড়িয়ে। আর ছোট -মিশুক বেশি চলাচল করে শহরের ভেতরে, অনেকটা নিরাপদ এলাকায়। প্রাইভেট পরিবহনের মতো একজন যাত্রী নিয়েও চলে। আমদানির পাশাপাশি দেশেও তৈরি হয়, দাম কম। তবে পুলিশের ভাষ্য, এসবের চাইতেও ছিনতাইকারীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো ছিনতাই নিরাপদ সুবিধা। অটোর ধরণ সেখানে প্রধান নয়।
এনজিও থেকে সহজে দেড়- দুই লাখ টাকার মতো ঋণ নিয়ে অটোরিকশা কেনার বেশ ধুম আছে। এতে নিশ্চিন্তে চলে যায় ৫-৬ জনের সংসার। সাপ্তাহিক ঋণের কিস্তিও সহজে পরিশোধ করে দেয়া যায়। সহজ উপার্জন মাধ্যম।
ছিনতাইয়ের শিকার প্রাণে বেঁচে যাওয়া এক অটো চালকের ভাষ্য, থানায় অভিযোগ করে শেষে গাড়ির সন্ধান পাই। শুধু বডি পাওয়া গেছে। চারটা ব্যাটারী, অতিরিক্ত একটি চাকা, লাইট, মেশিনসহ কিছুই পাইনি। সবকিছুই খুলে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। আগে ছিনতাই শহরের বাইরে, নির্জন কোন জায়গায় হতো। এখন শহরের ভেতরই, দিনের বেলাতেই ছিনতাই হচ্ছে।
কুমিল্লা টিক্কাচরের চালক খুনের ঘটনার পরপরই পুলিশ ব্যাপক তৎপর হয়। ছিনতাই ও খুনী চক্রের পাঁচ সদস্যকে আটক করে। তাদের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি অটোও উদ্ধার করা হয়। চক্রের মূল মাস্টারমাইন্ডকেও পরবর্তীতে গ্রেফতার করা হয়। সংঘবদ্ধ চক্র ক্রিয়াশীল এটা আবারও স্পষ্ট হলো এমন গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে। এতে আপাতত গড়ে ওঠা একটা চক্র হয়তো নিয়ন্ত্রণ হলো।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, অপরাধীকে ভয় দেখানোর ক্ষেত্রে পুলিশের ব্যর্থতা, দুর্বল মামলা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সম্প্রতি বেশ ক’টি মামলার রায় হয়েছে। একটি মামলায় মুন্সিগঞ্জে চার জনের মৃত্যুদণ্ড, চট্টগ্রামে তিন আসামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ঘটনার তিন বছরের অধিক চার বছরের মধ্যেই মামলা নিষ্পত্তি করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলা যায়। এসব দৃষ্টান্ত- রায় এমন নৃশংস অপরাধ প্রবণতা কমাতে সাহায্য করবে এটাও বিশেষজ্ঞ মত।
অপরাধী দমনে মূল ভূমিকা পুলিশের। পাশাপাশি যাত্রী ও চালকদের সচেতন হতে হবে। সামাজিক ভাবে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। পুলিশের ভাষ্য, ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যাত্রীদের প্রথম নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব চালকের। সে নিজেই যখন জীবন- মৃত্যুর ঝুঁকিতে চলে যায় তখন আর কিছুই করার থাকে না। আবার অনেক সময় এসব অপরাধের সাথে চালকরাও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকে।
অটো ও চালক দুইয়েরই লাইসেন্স দেয়া প্রয়োজন। দিলে আইন স্বীকৃত হয়। এটা এমন নৃশংস অপরাধ কমাতে সাহায্য করবে। ছিনতাই কমবে। মানে নির্দিষ্ট করা, সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা, সড়কে শৃঙ্খলা আনা ও স্বীকৃত পন্থায় চলাচল করতে দেয়া। এখন দয়ায় চলছে। রাষ্ট্র স্বীকৃত অধিকারে চললে নিরাপত্তা যেমন বাড়বে তেমনি নৃশংস এ অপরাধও কমে আসবে।
মাসুক আলতাফ চৌধুরীঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক, সাবেক সভাপতি, কুমিল্লা প্রেসক্লাব
কুমিল্লা