মাসুক আলতাফ চৌধুরীসা: সাপ-শুনলেই ভয় আর আতঙ্ক। সাপে ভয় নেই এমন মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার ও গুজব উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বিপরীতে সঠিক তথ্য প্রচারণায় পিছিয়ে থাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গুজব ঠেকাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। পরিস্থিতি বিবেচনায় গণমাধ্যম সত্য- সঠিক প্রচারনায় জোর দিয়েছে। গণমাধ্যমের সামনে সাম্প্রতিক বড় চ্যালেজ্ঞই হচ্ছে এসব গুজব ঠেকানো। সরকার এসব ক্ষেত্রে বরাবরই দুর্বল। গুজব এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে, মানুষ নির্বিচারে সাপ মেরে তা ফলাও করে প্রচার করছে। সাপ মারলে পুরস্কার ঘোষণারও খবর মিলেছে। সাপের ওপর এমন আগ্রাসী মনোভাব প্রাকৃতিকভাবে প্রাণীর ভারসাম্য রক্ষা প্রক্রিয়াকে হুমকির মুখে ফেলেছে। হত্যার শিকার ৮০ ভাগ সাপে বিষ নেই। সাপকে মেরে ফেলা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ, এরা সংরক্ষিত প্রাণী। রাসেলস ভাইপারের আক্রমণ থেকে বাঁচতে প্রয়োজন সর্তকতা। মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও কৃষির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক। উপদ্রুত এলাকায় ক্ষেতে শ্রমিক মিলছে না।
রাসেলস ভাইপারের অস্তিত্ব দেশে আগে থেকেই রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় সাপটি চন্দ্রবোড়া নামেই অধিক পরিচিত। তবে অন্য নাম উলুবোড়া। ইংরেজি নাম রাসেলস ভাইপার। বর্ষা- বন্যার সময় (মে- জুলাই) এমনিতেই বাড়ে সাপের উপদ্রব। সম্প্রতি বৃষ্টি ও বন্যা দেখা দেয়ায় বিচরণ বেড়েছে সাপের। কোন কোন এলাকায় রাসেলস ভাইপারও মিলছে, প্রকোপ বেড়েছে। দেশের উত্তর ও উত্তর- পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায়, বিশেষ করে রাজশাহী বিভাগের পদ্মা তীরবর্তী কয়েকটি জেলা- বরেন্দ্র অঞ্চল ও আড়িয়াল খাঁ চরাঞ্চলে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এই অঞ্চলই রাসেলস ভাইপারের আদি নিবাস। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় এই প্রজাতির সবচেয়ে উপস্থিতি ছিল। সরকারী হিসেবে ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জেই গত তিনমাসে ৫ জন মারা গেছে। এই সাপের কামড়ে দেড় বছরে শুধু রাজশাহী মেডিকেলেই মারা গেছেন অন্তত ১৮ জন। এ সময়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৬৮ জন। এ পর্যন্ত রাসেলস ভাইপারে কতজন মারা গেছে তার সঠিক হিসাব নেই। ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ ও চাঁদপুরে রাসেলস ভাইপারের কামড় বা দংশনের খবর মিলেছে। কুমিল্লায় সাপটির দেখা মিলেছে এমন গুজব আছে, সত্যতা নেই। ২০০২ সাল পর্যন্ত বরেন্দ্র অঞ্চল- রাজশাহী, রংপুর এবং চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের ১২ জেলায় রাসেলস ভাইপারের বিস্তৃতি ছিল। ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৭ জেলায়, গত বছর পর্যন্ত ২৫ জেলায় আর এখন ২৭ জেলায় বিস্তৃতি- পাওয়া গেছে। যে তালিকায়ও কুমিল্লা নেই, তবে চাঁদপুর আছে। তার মানে কুমিল্লায় রাসেলস ভাইপারের দেখা পাওয়া যায় নি, কাটা রোগীরও দেখা মেলেনি, বনবিভাগের তালিকা অনুযায়ী। কুমিল্লা সদর উপজেলার শালধর এলাকায় গোমতী নদীর চরে মাছ ধরার পাতাজালে একটি ছোট অজগর আটকে যায়। শনিবার (২২ জুন) সকালে মৃদু বিষধর অজগরটি পিটিয়ে মারা হয়। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাসেলস ভাইপার বলে গুজব ছড়ায়। ছোট অজগর দেখতে অনেকটা রাসেলস ভাইপারের মতো।
প্রচলিত আছে রাসেলস ভাইপার কামড়ালে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম- নিশ্চিত মৃত্যু। ভয়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা সেখানেই। গুজবও ডালপালা ছড়িয়েছে এমন ভয় থেকেই। আসলেই কি এতটা ভয়ংকর এই রাসেলস ভাইপার।
প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মত, দেশে প্রধান তিনটি বিষাক্ত সাপ হলো গোখরা (কোবরা), কেউটে (ক্রেইট) এবং রাসেলস ভাইপার। দেশে ২ প্রজাতির গোখরা, ৫ প্রজাতির কেউটে রয়েছে। সবগুলোই বিষধর। অবশ্য এই তিনটিসহ ভারতীয় উপমহাদেশে ৪ প্রজাতির বিষধর সাপ রয়েছে। আফ্রিকার বিষধর ভাইপার যা গাবুন ভাইপার নামে পরিচিত, বিশ্বের অন্যতম বিষাক্ত সাপ,আমাদের এখানে নেই। রাসেলস ভাইপার ভিন্ন প্রজাতির ভারতীয় উপমহাদেশের সাপ। পৃথিবীতে ৪ হাজার ৭৩ প্রজাতির সাপ আছে। তারমধ্যে মাত্র ২০ ভাগ সাপ বিষধর। দেশে প্রায় ৮০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। যার মধ্যে ২৭ প্রজাতির সাপ বিষধর। অন্য পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রায় ১০৪ প্রজাতির সাপের মধ্যে ৩০ প্রজাতিই বিষধর। তার মানে বেশির ভাগ সাপের কামড়ে বিষ নেই। বিষধর সর্প দংশনে পরবর্তী বিষক্রিয়ায় অনেকের মৃত্যু ঘটে। দেশে প্রতিবছর সাপের কামড়ে যত লোক মারা যায় তার অর্ধেক মারা যায় পাতি কেউটে সাপের কামড়ে।
চার হাজারেরও বেশি সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা দেওয়া ডাঃ ফরহাদ উদ্দিন হাসান চৌধুরী নিজের ফেসবুকে লেখেন, কোবরা, কেউটে, রাসেলস ভাইপার সব ধরনের সাপের কামড়ের চিকিৎসা করেছি। দুর্ভাগ্যবশত রাসেলস ভাইপারের ক্ষেত্রে ৫০ ভাগের বেশি রোগীকে বাঁচাতে পারিনি। তবে আক্রান্ত হওয়ার পরপরই দ্রুততম সময়ে হাসপাতালে আসলে, অতিদ্রুত অ্যান্টিভেনম শুরু করলে ও সাপোর্টিভ চিকিৎসা যেমন- ডায়ালাইসিস, ভেন্টিলেশন (আইসিইউ) ইত্যাদি দিলে রোগী বাঁচানো সম্ভব বলে মনে করি। এই সাপের বিষ শরীরে প্রবেশ করলে মূলত শরীরের রক্ত পাতলা হয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে নিজে নিজেই রক্তক্ষরণ হতে পারে, কিডনি বিকল হতে পারে, স্নায়ু অবশ হয়ে ফুসফুসের কার্যকারিতা হারিয়ে যেতে পারে, লিভার আক্রান্ত হতে পারে, এমন কি হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে। রাসেলস ভাইপারের বিষ এক জটিল মিশ্রণ- হেমোটক্সিন, যা রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতাকে ব্যাহত করে। এই বিষক্রিয়ায় মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়।
তার মতে, বাংলাদেশে সর্প দংশন প্রতিরোধী যে অ্যান্টিভেনম রয়েছে তা কোবরা ও কেউটের বিপরীতে ভালোভাবে কাজ করলেও রাসেলস ভাইপারের বিরুদ্ধে ভালোমতো কাজ করে না। এই অ্যান্টিভেনমটি ভারতীয় রাসেলস ভাইপারের বিরুদ্ধ উপাদান রয়েছে। ভারতে বেশ কার্যকর। আমরা আমদানি করি। ভারতীয় রাসেল ভাইপারের বিষ এবং বাংলাদেশের রাসেলস ভাইপারের বিষে উপাদানগত বৈসাদৃশ্য বেশি হওয়ায় এটি পুরোপুরি কাজ করে না। তারপরও ভয়ের কারণ নেই। দেশে এই অ্যান্টিভেনম দিয়েই চিকিৎসা দেয়া হয়। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা গেলে জীবন বাঁচানো যায় সহজেই। কত দ্রুত সময়, বিষধর সাপ হলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে সাধারণত বেশিরভাগ লক্ষণ প্রকাশ পায়। বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির সভাপতি ও দেশের খ্যাতনামা সর্প দংশন বিশেষজ্ঞ ডাঃ মোঃ আবুল ফয়েজ সাপের দংশন ও চিকিৎসা নিয়ে বই লিখেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, গোখরা সাপের দংশনের গড় ৮ ঘন্টা পর, কেউটে দংশনের ১৮ ঘন্টা পর এবং রাসেলস ভাইপার দংশনের ৭২ ঘন্টা বা তিন দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সময়সীমার মধ্যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা জরুরি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ আহসানের মতে রাসেলস ভাইপার কামড়ালে একশ মিনিট বা দেড় বা পোনে দুই ঘন্টার মধ্যে চিকিৎসা নিতে পারলে ঝুঁকি কমে যায়। বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়লে অ্যান্টিভেনম কাজ করে না। ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশন বলছে যে সব সাপের বিষের মাত্রা জানা গেছে (সামুদ্রিক সাপসহ) তাদের মধ্যে রাসেলস ভাইপার সপ্তম। তাই রাসেলস ভাইপার দেশের সবচেয়ে বিষধর বা সবচেয়ে প্রাণঘাতী সাপ নয়। বিশেষজ্ঞ আরও মত, আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে এটা মারাত্মক প্রথম ৩০ সাপের মধ্যে নেই। তবে এটির অবস্থান আমাদের দেশের গোখরা সাপের পর। গবেষক মোঃ আবু সাইদের মতে, এটি গোখরা বা কেউটের চেয়ে কম প্রাণঘাতী কিন্তু এই সাপের বিষে নানা ধরনের উপাদান বেশি। ফলে চিকিৎসায় বিলম্ব হলে বহুমাত্রিক জটিলতা তৈরি করে শরীরে। তার মতে, অনেক সময় গোখরা বা কেউটে কামড়ালে টের পাওয়া যায় না। কিন্তু রাসেলস ভাইপার কামড় দিলে জায়গাটা সাথে সাথে ফুলে যায় এবং সাপটি সাথে সাথেই চলে যায় না- দেখা যায়। এতে চিকিৎসা সহজ হয়, কোন সাপ কামড়েছে তা বলা যায়। এতে মৃত্যু ঝুঁকি কমার কথা, কিন্তু দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
ডাঃ ফরিদ আহসান আরও জানান, আমাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের একদল গবেষক রাসেলস ভাইপারের অ্যান্টিভেনম তৈরীতে গত ৪-৫ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। অদূর ভবিষ্যতে দেশীয় অধিক কার্যকরী অ্যান্টিভেনম পাওয়া যাবে। সরকারকে এদিকে মনোযোগী হতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, দেশে ২০২৩ সালে চার লাখ সাপের কামড়ের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে সাড়ে সাত হাজার মানুষ মারা গেছে। যাদের বেশির ভাগই গোখরা ও কেউটে প্রজাতির সাপের কামড়ের শিকার হয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই প্রান্তিক- গ্রামের খেটে খাওয়া কৃষক ও সাধারণ মানুষ। তবে এক্ষেত্রেও রাসেলস ভাইপারে মৃত্যুর সঠিক হিসাব রাখা হয় নি। প্রতিবছরই সাপের কামড়ে বহু গবাদিপশুরও মৃত্যু ঘটে।
রাসেলস ভাইপার- এই প্রজাতিটি বহুবছর আগে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু গত ১০-১২ বছর আগ থেকে আবারো এই সাপে কামড়ের ঘটনা ঘটছে। গত কয়েক মাসে একাধিক জেলায় সাপটি দেখা গেছে। এরপরই আলোচনা- গুজব ছড়াতে থাকে। কি ভাবে বিলুপ্ত প্রায় সাপটি আবার ফিরে এসেছে তা নিয়ে গবেষণা চলছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন সব সরকারি হাসপাতাল- উপজেলা বা স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে বিষ প্রতিষেধক-অ্যান্টিভেনম দেয়া হয়। সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে, পর্যাপ্ত আছে। অবশ্য খোলা বাজারেও অ্যান্টিভেনম কিনতে পাওয়া যায়। বিষধর এ সাপের দংশনের ফলে ব্যাথা, ফোলা, রক্তক্ষরণ, প্যারালাইসিস, রক্তজমাট বাঁধা, শক, চোখ বুজে আসা, নাকিস্বরে কথা বলা, কথা বলতে অসুবিধা কিংবা মুখ দিয়ে লালা ঝরলে, কিডনি বৈকল্য ইত্যাদি সিন্ড্রোম দেখে নিবির পর্যবেক্ষণে রেখে সাপের বিষের ওষুধ অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা হয়ে থাকে যথেষ্ট সর্তকতার সাথে। অভিজ্ঞ ও কনফিডেন্ট চিকিৎসক রোগীর সিন্ড্রোম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ডোজ (সকল বয়সের রোগীর ক্ষেত্রে একডোজে ১০ ভায়াল) প্রয়োগ করবেন যথেষ্ট পর্যবেক্ষণে রেখে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রথম ডোজের পর দ্বিতীয় বা তৃতীয় ডোজও লাগতে পারে, এভাবে ১০ ডোজ- এটাই বড় চ্যালেজ্ঞ। আবশ্যক প্রয়োজন ছাড়া অ্যান্টিভেনম ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ সব সর্পদংশনে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া অযৌক্তিক ও অযাচিত ব্যবহারের পর কিছু রক্তগত জটিলতা হতে পারে। এমন অভিজ্ঞ চিকিৎসক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাওয়া কঠিন। পেলেও আইসিইউ এবং ডায়ালাসিস সুবিধা মেডিকেল কলেজ বা জেলা সদর হাসপাতাল ছাড়া পাওয়া যায় না, থাকলেও অপ্রতুল। তাই চিকিৎসা সহজ আবার কঠিনও। অভিজ্ঞ ডাক্তার পাওয়াও কঠিন। আবার সচেতনতার অভাবে হাসপাতালে না গিয়ে ওঝার কাছে গিয়ে বেশিরভাগ প্রান্তিক মানুষের অপমৃত্যু হয়। সর্পদংশন সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা সমাজে বিরাজমান। এই উপমহাদেশে সাপের দংশনের ঐতিহ্যগত চিকিৎসা- ওঝা প্রচলিত এখনও। রোগীকে সর্বপ্রথম নেয়া হয় ওঝার কাছে। পরে একেবারে শেষ- মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। অথচ সময় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে প্রথম ১০০ মিনিট। এই সময়ের মধ্যেই দ্রুত রোগীকে উপজেলা বা জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসা দরকার।
বর্তমান সময়ে অধিক চাষাবাদের জন্য নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, বনভূমি ও চরের প্রাকৃতিক প্রাণী আবাস নষ্ট করা, গণহারে রাসেলস ভাইপার সাপের প্রাকৃতিক শিকারী, যারা সাপ খায়- শিয়াল, বেজি, চিল, বাজ, খাটাশ, বনবিড়াল, মেছো বিড়াল, পেঁচা, গুইসাপ, বানর,বাগডাশ, গন্ধগোকুল, তিলা নাগ ইগল, সারস, মদনটাক পাখি ও কিছু প্রজাতির সাপ হত্যার কারণে পরিবেশে- এসবের খাদ্যচক্রে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আর বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় এসব সাপের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে একচেটিয়া । আবার সাপ মেরে ফেলার মাধ্যমেও এর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ব্রিটিশ আমলে সরকারি উদ্যোগে সাপ মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং যথারীতি ঘটা করে সাপও মারা হয়েছিল কিন্তু সর্পদংশনের সংখ্যা বা সাপের বংশ কোনটিই কমে নি।
রাসেলস ভাইপারের দেহের রং সাধারণত বাদামি বা ধূসর, যার ওপর হলুদ বা কালো ছোপ থাকে। গোল গোল দাগগুলোর মাথা ছুঁচালো। কাঠ বা মাটির রং হওয়ায় শুকনো পাতা বা মাটিতে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে। তাই হুট করে দেখা যায় না। জিহবার রং বাদামি বা কালো। এটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪ ফুট লম্বা হতে পারে। এরা প্রধানত রাতে সক্রিয় থাকে – নিশাচর , তবে দিনেও সক্রিয় হতে পারে। এটি সাধারণত কৃষিজমিতে খোলা জায়গা- ক্ষেত, ঝোপঝাড়, মাটির গর্ত, ফসলের গোলা গ্রামীণ এলাকায় বাস করে। বরেন্দ্র অঞ্চলে আগে একটি বা দু’টি ফসল হতো। ‘৯০ দশকে সেচ পদ্ধতির উন্নতির পর থেকে সেই জমিগুলোতে দু’টো বা তিনটে ফসল হয়। ফলে সেখানে ইঁদুরের উপস্থিতি বেড়েছে। আর রাসেলস ভাইপারসহ সব সাপেরই প্রধান খাদ্য ইঁদুর। ফলে জমিতে ফসল হলে ইঁদুর হচ্ছে আর ইঁদুর হলে সাপও বাড়ছে। অধিক প্রজনন ক্ষমতা সম্পন্ন এই সাপ ডিম না দিয়ে একসাথে ২০-৮০ টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়, ফলে দ্রুত বংশ বাড়ছে। মাটিতে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও এরা সাঁতার ভালো কাটতে পারে। ফলে বাচ্চাগুলো নদীর পানিতে বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছে। আবার নদীর স্রোতে কচুরিপানার মাধ্যমে ভারতের লাগোয়া অঞ্চল থেকেও রাসেলস ভাইপার ভেসে এসেছে। সাধারণত বিরক্তবোধ না করলে কিংবা আত্মরক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে এমনটি মনে না করলে অনেকটা শান্তই থাকে এরা, তবে তেজি। বিপদ আঁচ করতে পারলে এটি কুন্ডলী পাকিয়ে অবস্থান নেয়। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিষদাত রাসেলস ভাইপারের। দ্রুততর সময়ে ছোবল দিতে পারে। অধিকাংশ সময়ই প্রেসারকুকারের মতো জোরে ‘হিস হিস’ শব্দ করে নিজের অবস্থান জানান দেয়। এমন অবস্থায় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সেই স্থান ত্যাগ করে ছোবল থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়।
গত কয়েক বছরে রাসেলস ভাইপার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া এবং লোকালয়ে চলে আসার বড় কারণ সাপের প্রাকৃতিক বাসস্থান বনাঞ্চল এবং কৃষি জমি সম্প্রসারণের ফলে নষ্ট-ধ্বংস বা পরিবর্তন। ফলে এইসব সাপ জনবসতি এলাকায় চলে আসছে। আবার আবহাওয়া বা ঋতু পরিবর্তনের কারনেও সাপের আচরণে পরিবর্তন আসছে এবং তারা নতুন এলাকায় বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। খাদ্যের অভাবে নতুন শিকার খুঁজতে ও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে মানুষের আবাসস্থলের কাছাকাছি চলে আসছে। তার মানে প্রকৃতিতে এদের খাদ্য কমে গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও অতিরিক্ত গরম অনুভূত হচ্ছে। আর নদীর পানির পরিমান বেড়ে যাচ্ছে। এমন পরিবেশ রাসেলস ভাইপারের বেঁচে থাকা ও বংশবৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত। এর প্রজননকাল ৬ মাসের বেশি- মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তবে মৌসুম মে থেকে জুলাই। সে কারণে সাপটির দেখা মিলছে বেশি।
২০১২ সালের পর থেকে এই সাপের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরা দক্ষ সাতারু তাই নদীর স্রোতে ও পানিতে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। যে সব জায়গায় এই সাপ পাওয়া গেছে তার অধিকাংশ জায়গাতেই কচুরিপানা রয়েছে। আবার কচুরিপানার মধ্যেও এই সাপ পাওয়া গেছে। তাই ধরে নেয়া হচ্ছে কচুরিপানার ওপর ভেসে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এই সাপ বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছেছে।
রাসেলস ভাইপার কামড়ালে করনীয় হচ্ছে দংশিত অঙ্গ হাত- পা নাড়াচাড়া না করা। অধিক নাড়াচাড়ায় বিষ শরীরে সহজে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা সাধারণত সাপ কামড় দিলে গিঁট বা বাঁধ দেই কিন্তু রাসেলস ভাইপারের কামড় নিশ্চিত হলে আক্রান্ত অংশে গিঁট বা বাঁধ দিতে নিষেধ করা হয় কারণ বাঁধের কারণে মাংসপেশির ভিতরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে উল্টো অঙ্গহানি হতে পারে। আক্রান্ত স্থান সাবান দিয়ে আলতোভাবে ধুয়ে দিলে বিষ নষ্ট হয়। ঘড়ি, অলংকার, তাবিজ,তাগা শরীর থেকে খুলে ফেলতে হবে। দংশিত স্থানে কাটা, সুই ফোটানো, কোন কিছুর প্রলেপ দেয়া বা লাগানো যাবে না।
আর কামড় বিশেষ করে পায়ের কামড় এড়াতে কৃষকদের বুট, জুতা এবং লম্বা ভারী বা জিন্সের প্যান্ট পরিধানের পরামর্শ দেয়া হয়েছে, এতে পায়ের কামড় থেকে রক্ষা মিলবে। রাতে চলাচলে লাঠি ও টর্চ লাইট ব্যবহার করা ভালো। আলো দেখলে সাপ সরে যায়। বাড়ীর চারপাশ পরিষ্কার ও আবর্জনামুক্ত রাখা, পতিত গাছ, জ্বালানি লাকড়ি ও খড় সরানো, ধান- চালের বড় মটকা- ফসলের গোলা, বাইরের রান্না ঘর, হাস- মুরগীর খোঁয়াড় ব্যবহারে অধিক সর্তক থাকা প্রয়োজন। কারণ সাপে কাটা রোগীর ৭০ ভাগ পায়ে ও ১৫ ভাগ হাতে কামড় খান। ফরিদপুর কৃষি বিভাগের পরামর্শে স্থানীয় কৃষকরা ক্ষেতে মশার কয়েল জ্বালিয়ে কাজ করেন। ধোঁয়া সাপের চোখে গেলে সাপ সরে যায়। এ পদ্ধতি ব্যবহারে সুফল মিলছে।
চন্দ্রবোড়ার নামই রাসেলস ভাইপার। বৃটিশ শাসনামলে স্যার প্যাট্রিক রাসেল ভারতীয় উপমহাদেশে সাপের শ্রেণিবিন্যাস করণে নিয়োজিত হন। সময়টা সতেরো শতকের শেষের দিকে, চূড়ান্ত হয় আঠারো শতকের শুরুতে। তার মধ্যে চন্দ্রবোড়া ছিল। পরে তার নাম জুড়ে দেয়া হয় বলে এই সাপের পরিচিত দাঁড়ায় রাসেলস ভাইপার নামে।
রাসেলস ভাইপার অন্য সাপের মতো ইঁদুর খেয়ে যেমন ফসল রক্ষা করে, তেমনি পরিবেশে ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সাপের বিষ থেকে অনেক জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি হয়। সাপ মারা, ধরা, রেখে দেয়া, ক্ষতিসাধন দণ্ডনীয় অপরাধ।
মানুষ যেমন সাপকে ভয় পায়, সাপও তেমন মানুষকে এড়িয়ে চলে। প্রায় সব সাপই মানুষের উপস্থিতি টের পেলে সরে যায়। রাসেলস ভাইপার খুবই অলস প্রকৃতির। তবে এটি নিজ থেকে তাড়া করে দংশন করে না। অসাবধানতাবশত কেউ গায়ে পারা দিলে বা ভয় পেলে আত্মরক্ষায় ছোবল দেয়, তাই সচেতনতা বা বর্তমানে অধিক সচেতনতা ও সুরক্ষার কথা বলা হচ্ছে, যা রক্ষা কবচ হতে পারে। সাপের আবাসস্থল এড়িয়ে চলতে হবে। নিজ বসতে সাপের আবাসস্থল যাতে না করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সাপ না মেরে প্রতিরোধ, সর্তকতাই বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যবস্থা। দেশের অর্ধেক জেলায় এ সাপ ছড়িয়েছে। তাই আতঙ্ক নয়, সচেতনতা বাড়াতে হবে, নিতে হবে ব্যবস্থা। প্রয়োজনে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩, নিকটস্থ বনবিভাগ, বনবিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের হটলাইন এবং বেসরকারি সংগঠন স্নেক রেসকিউ টিম বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
পরিচিতিঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।