– মাসুক আলতাফ চৌধুরী : শিক্ষার্থী কম, কলেজ বেশি তাই আসন ফাঁকা। তার মানে প্রয়োজনের তুলনায় কলেজ বেশি হয়ে গেছে। সারা দেশের প্রায় একই চিত্র। এসএসসি ও সমমান সব মিলে কারিগরি, মাদ্রাসাসহ দেশের ১১ টি শিক্ষা বোর্ডে এবার পাশ করেছে ১৭ লাখ ছাত্র- ছাত্রী। আর একাদশে আসন আছে ২৫ লাখ। সেই হিসাবে একাদশে ফাঁকা থাকবে ৮ লাখের বেশি আসন। এরমধ্যে ৬ জেলার কুমিল্লা বোর্ডে খালি থাকবে দেড় লাখ আসন। পাশ করা সব শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয় না। গত বছর ৩ লাখ পাশ করা শিক্ষার্থী ভর্তি হয় নি। প্রতিবছরই গড়ে ৩-৪ লাখ ভর্তি হয় না। এবার এসএসসি পাশের হার গতবারের চেয়ে আড়াই ভাগের বেশি ছিল। মাদ্রাসা কিংবা অনিয়মিত শিক্ষার্থীরা ভর্তি হলেও বিপুল পরিমাণ আসন খালি থেকে যাবে। আগের বছরগুলোতেও আসন খালিই থেকেছে। এসএসসির পাশের হারের সাথে আসন পূরণ বা খালি থাকার সম্পর্ক রয়েছে।

এতো আসন খালি কেন। কারিগরি বোর্ডের অধীন ডিপ্লোমা কোর্স রয়েছে। রয়েছে মাদ্রাসা বোর্ডও। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় এইসব কলেজ, মাদ্রাসা, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন বেশির কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি। এসব প্রতিষ্ঠানেরই অধিকাংশ আসন খালি থাকে। আসন খালির হিসাবটা এসবসহ, সামগ্রিক। এসএসসি পাশ করলেও একটা বড় অংশ মূলধারার শিক্ষা থেকে সরে কারিগরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি হয়। আবার অনেকে বিদেশে লেখাপড়া বা কর্মে চলে যায়।

কলেজ বেশি কেন। রাজনৈতিক নেতারা নাম- সুখ্যাতি রাখতে কলেজ করে। টাকা-পয়সার মালিকরাও একই কারণে এলাকায় কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। আবার প্রকৃত শিক্ষানুরাগীরাও কলেজ করে। অনেকে বানিজ্য করতে কলেজ করে। এ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছে রাজনীতিবিদ ও টাকার মালিকেরা। সবার টার্গেট একটাই দ্রুত এমপিও ভূক্তি, হয়ে গেলেই কলেজ টিকে যায়। এরজন্য ক্ষমতার রাজনীতি লাগে। তারা নূন্যতম শর্ত মেনে কলেজ করে। মান সেখানেই হারিয়ে যায়। স্বীকৃতি, পাঠদান অনুমতি, নবায়ন, গর্ভনিং বডির অনুমোদন এসব প্রক্রিয়া শিক্ষা বোর্ডের কাছে থাকলেও তারা অসহায় হয়ে থাকে। এসব বেসরকারি কলেজ শিক্ষার মান বৃদ্ধির চাইতে বানিজ্যকে বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলে আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়।

সরকারিতে বেশি আগ্রহ, বেসরকারিতে খালি। দেশের শীর্ষ স্বনামধন্য কলেজগুলোতে সবাই ভর্তি হতে চায়। বিশেষ করে ঢাকার শীর্ষ কলেজগুলোতে বরাবরের মতো ভর্তি লড়াইটা বেশি। কারণ নামকরা, ভালো মানের প্রতিষ্ঠান, রেজাল্ট ভালো হয়। নামকরা কলেজে ভর্তি জটিলতা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। দেশে মান সম্পন্ন ও ভালো কলেজের সংখ্যা দুইশো। এতে আসন আছে এক লাখের কাছাকাছি, চাহিদার তুলনায় কম। এরমধ্যে ঢাকায় উচ্চমান সম্পন্ন কলেজ ২৫-৩০টি। এগুলোতেই ভর্তির আগ্রহ বেশি, তীব্র প্রতিযোগিতা। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। বরাবরের মতো এবারও জিপিএ-৫ পেয়েও পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে পারবে না শিক্ষার্থীরা। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীন ৬ জেলা- কুমিল্লা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষীপুর ও ফেনীতে ৪৬১ টি কলেজ রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে অন্য কলেজে ভর্তি হয়। আবার বার বার একই কলেজগুলো পছন্দের তালিকায় রাখায় অনেকে অনলাইনে ভর্তি হতে পারে না, আসন খালি না থাকায়। পরে তারা অপছন্দের ভিন্ন কলেজে ভর্তি হয়, বাধ্য হয়ে।

সারাদেশের কলেজগুলোতে একাদশে ঠিক কতটি আসন রয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই। পরিসংখ্যানে আসন সংখ্যা না থাকলেও কলেজগুলোতে কতজন ভর্তি হয় তার তথ্য রয়েছে। একাদশেও কোটা প্রথা রয়েছে। ৯৩ ভাগ আসন উন্মুক্ত। ২ ভাগ শিক্ষা মন্ত্রনালয়, অধীনস্থ দপ্তর বা সংস্থার কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের সন্তান আর ৫ ভাগ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত।

অন্যদিকে একাদশে ভর্তি প্রক্রিয়া অনলাইনে হওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পছন্দ করার বিষয়টি শিক্ষার্থীদের হাতে চলে আসে। ফলে যেসব কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি হয় না, তারা নতুন করে বিভাগ আর শাখা খুলে শিক্ষার্থী পাওয়ার চেষ্টা করে। এতে আসন বাড়ে। ভর্তি বেশি, মুনাফা বেশি। সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরেও অতিরিক্ত আদায়ের সুযোগ রয়েছে, হচ্ছেও। সরকারি- বেসরকারি সব কলেজই একাজ করছে।

আমাদের শিক্ষাও শহরমুখী। অনলাইনে আবেদন করার সময় শহরমুখী কলেজেই বেশি আবেদন পড়ে। গ্রামের কলেজগুলো খালিই পড়ে থাকে। এ কারণে আসন বেশিই খালি থাকছে, গ্রামের কলেজগুলোতে।

চাহিদা আর সক্ষমতা বিবেচনা করে কলেজে আসন অনুমোদন করা হয়। আসন ফাঁকা থাকলেও পাঠদানের অনুমতি ও আসন বাড়ানো অব্যাহত রয়েছে। যা পূর্বে অনুমোদিত হয়ে আছে, সেটাতো থাকছেই। চলতি বছর আরও ৮০০ আসন অনুমোদন দিয়েছে ঢাকা শিক্ষাবোর্ড। আবেদন করলে ১৫-২০ টি বাড়ে। আবার কারোটা বাড়ে না। সরকারি কলেজগুলো আসন বাড়াতে বাধ্য হয়, রাজনৈতিক চাপ থাকে। এসব কলেজে ভর্তির চাহিদা থাকে। বিজ্ঞান বিভাগেই আসন বাড়ে অধিকাংশ। তাদের ব্যবসা শিক্ষা ও মানবিক বিভাগে আসন খালি থাকে। শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যানকে ক্ষমতা দেয়া আছে। তিনি মূল্যায়ন করে অনুমোদন দেন। এভাবেই প্রতিবছর আসন বাড়ে। এর বাইরে দেশের কলেজগুলোর বেসরকারির বড় একটি অংশই বাণিজ্য এবং প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন ছাড়াই আসন বাড়িয়ে যাচ্ছে। তারাও ক্ষমতা ও রাজনৈতিক তদ্বির করে। এই চাপ শিক্ষা বোর্ড নিতে পারে না। এসব কারণেই একাদশ শ্রেণিতে দীর্ঘদিন ধরেই লাখ লাখ আসন খালি। নতুন করে আসন বাড়ানোর লাগামটা তাই টানা দরকার।

বর্তমান এমন পরিস্থিতিতে কি হচ্ছে বা হবে। সরকারি- বোর্ডের নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষার্থী ভর্তি ও তাদের পরীক্ষা উপযোগী করতে না পারলে অনেক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বেসরকারি নতুন কলেজ সংকটের মুখোমুখি হবে। শিক্ষার্থী সংকটে কলেজের নিবন্ধন বা এমপিও হারানোর আশংকা রয়েছে। স্বীকৃতি নেয়া বা নবায়নের জন্য যে শর্ত আছে, সে অনুযায়ী কাম্য শিক্ষার্থী না পেলে স্বীকৃতি বা এমপিও বাতিল হতে পারে, এমন ঝুঁকিতেই রয়েছে বেশিরভাগ কলেজগুলো।

এতে সাধারণ পণ্যের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী টানতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বাড়বে, বেড়েছে । যদিও প্রতিযোগিতায় ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে যাবে। আর যারা শিক্ষাদানে মান ও দক্ষতা দেখাতে পারবে না, তারা পিছিয়ে পড়বে। বোর্ডের নীতিমালা অনুযায়ী নূন্যতম ভর্তি, পাশ করা টিকিয়ে রাখতে হবে, কলেজ ধরে রাখতে হলে। এটা মানদণ্ড, যদিও সেখানেও নানা ফাঁক- ফোকর আছে, চলছে। যারা এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে তারা টিকে থাকতে পারবে না। সংকট উত্তরনে ভর্তি প্রক্রিয়ায় ভারসাম্য এবং পিছিয়ে থাকা কলেজগুলোর মানোন্নয়ন জরুরি। নতুবা নূন্যতম শিক্ষার্থী নিয়ে চালানো কলেজগুলোর মানহীন পরিবেশ এবং পাঠদান এ সংকটকে আরও বাড়াবে। শিক্ষার্থী ভর্তির শর্ত পূরণে ব্যর্থ কলেজগুলো অস্তিত্ব হারানোর শংকায় রয়েছে। তাহলে শিক্ষাকেও কি সাধারণ পণ্যের মতো প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় ঠেলে দেয়া হলো, টিকে থাকলে থাকবে, নতুবা নিজেই বন্ধ হয়ে থাকবে।

দীর্ঘ কর্মঅভিজ্ঞ একজন বোর্ড কর্মকর্তার ভাষ্য, প্রতিষ্ঠান চায় শিক্ষার্থী না পেলেও আসন-সীট থাক। সিট কমালে কলেজগুলো মানতে চায় না। ঢাকায় শিক্ষার্থী উপচে পড়ে কয়েকটি নির্দিষ্ট কলেজে। অধিকাংশ খালি পড়ে থাকে। সীট কমিয়ে দিলে তারা বিভিন্ন মাধ্যমে বোর্ডের চেয়ারম্যানের সুপারিশ নিয়ে আসে। তাঁর মতে, এতোদিন বেড়েছে। এখন আসন কমাতে সমন্বিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আন্তবোর্ড মিটিংয়ের মাধ্যমে আনুপাতিক হারে সীট কমিয়ে আনতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ লাগবে। তার মানে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। তাহলে একটা কঠোরতার বার্তা পৌঁছাবে।তখন সবাই মানবে, মেনে নিতে হবে।

শিক্ষাবিদদের ভাষ্য, যখন দেখা যাবে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী কোন প্রতিষ্ঠান সুযোগ- সুবিধা দিতে পারবে না তখনই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার জন্য। তাদের মতে, ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে পিছিয়ে পড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে। এক জায়গায় বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলে সেগুলোকে একীভূত করা যেতে পারে। না হলে প্রতারণা বেড়ে, সংকট আরও বাড়াবে। বোর্ডের নীতিমালা অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৩ কিলোমিটার ও মফস্বল এলাকায় ৪ কিলোমিটারের মধ্যে একটিই কলেজ থাকবার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তবে ঘনবসতি কিংবা চরাঞ্চলের মতো কমবসতি এলাকায় নিয়মে ভিন্নতা রয়েছে। জনসংখ্যার একটা মানদণ্ড আছে এ ক্ষেত্রে। পাশের হার ও ভর্তির সংখ্যাগত মানদণ্ড নেই, তবে বিবেচনা আছে, সন্তোষজনক হতে হয়। রাজনৈতিক চাপ এসবে বেশ সুবিধা নিয়ে নেয়। একজনও পাশ করেনি এমন কলেজও টিকে আছে। তবে বোর্ড মানোন্নয়নে তদারকি করে, সাধারণ নিয়মে। এসবক্ষেত্রেও নীতিমালা যুগোপযোগী করা দরকার। শিক্ষায় কঠোরতা দরকার, শৃঙ্খলা বাড়বে। আরও নতুন কলেজ লাগবে কিনা, ফাঁকা আসনের কি হবে এসব নিয়ে মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে এসে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে, ভাবা দরকার। অলসতা এ ক্ষেত্রে মোটেও কাম্য নয়। গুরুত্ব অনুধাবন করা যেতে পারে।

পরিচিতিঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
কুমিল্লা, ২ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার, শব্দসংখ্যাঃ ১০৬০

Leave A Reply

আমাদের সম্পর্কে

যোগাযোগ ও আমাদের সম্পর্কে

All rights reserved by Desh Priyo News | Design and Developed by Sudipta Acharjee

Exit mobile version