শরিফুল হাসান : আপনার বাবার আয়টা হালাল তো? আপনার বাবা যদি সরকারি চাকরি করে থাকেন তাহলে জেনে থাকবেন আপনারা বাবা আইজিপি, সচিব, কর্মকর্তা থেকে শুরু করে যাই হোন না কেন এই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদের কর্মকর্তার বেতন স্কেল ৭৮ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে সবমিলিয়ে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা তিনি পেতে পারেন। এই যুগে সব খরচ সামলে কীভাবে তিনি এতো সম্পদের মালিক হন, কী করে তাঁর এতো গাড়ি বাড়ি থাকে, কী করে তিনি আপনাকে বিদেশে বা দামী স্কুলে পড়ানোর টাকা দেন আপনার সেই প্রশ্ন তোলা উচিত। সেই প্রশ্ন না তুলে আপনি যদি ১৫ লাখ টাকায় ছাগল আর ৩৭ লাখ টাকায় গরু কোরবানি দেন জেনে রাখবেন আপনিও ছাগলের চেয়ে অধম।
একইভাবে যদি আপনাদের একাধিক গাড়ি বাড়ি ফ্ল্যাট থাকে তাহলে সেই টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলুন। কারণ একজন সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীর যে বেতন সেই টাকায় সংসার চালিয়ে গাড়ি বাড়ি ফ্ল্যাট করার সুযোগ সীমিত। আজি আপনার বাবাকে সুপারম্যান ভাববেন না মনে রাখবেন তিনি একজন অসৎ মানুষ।
শুধু সরকারি চাকরিজীবী নন আপনার বারা রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, বিচারক, সাংবাদিক, শিক্ষক, উপাচার্য, প্রক্টর, প্রকৌশলী, বেসরকারি চাকরিজীবী কিংবা যাই হোন না কেন আপনি যদি গাড়ি বাড়ি থেকে শুরু করে যখন যা চান তাই পেয়ে থাকেন এবং আপনাদের জমিদারি না থাকে তাহলে বাবার সম্পদের উৎস নিয়ে সন্দেহ করুন। জানতে চান তিনি শতভাগ হালাল পথে উপার্জন করেন কি না?
একটা ভয়াবহ সমাজব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে আমরা। এইতো ২০-৩০ বছর আগেও যে লোকটা দুর্নীতি করতো তার দিকে সবাই বাঁকা চোখে তাকাতো। আর আজকে যেকোন ভাবে টাকা আয় করলেই, গাড়ি বাড়ি সম্পদ থাকলেই আমরা তাদের তোয়াজ করি। মসজিদ কমিটির সভাপতি থেকে শুরু করে নানান পথ পদবীতে বসাই। নানাভাবে তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে চাই। অথচ এই নোংরা কিটগুলোর আশ্রয় হওয়া উচিত ছিল জেলখানায়। আফসোস আমাদের দুদক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সব কাঠামো তাদের তোয়াজ করে। দুর্নীতিবাজরাই নানান পদে বসে। শুদ্ধাচার পুরস্কার পায়।
জানিনা রাষ্ট্র ব্যবস্থা কবে বদলাবে কিন্তু আমি মনে করি প্রতিটা প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের এগুলো বোঝা উচিত। আপনারা নিজের বাবা হলে সবার আগে সেই প্রশ্ন তোলা উচিত। কাজেই বাবার আয় হারাম হলে সেই আয়ে দেশে কিংবা বিদেশে বিলাসিতা না করে বাবাকে বলুন প্লিজ বাবা হারাম পথে আয় করো না। মানুষকে কষ্ট দিও না। দেশটির বারোটা বাজিও না। একইভাবে সব বাবাদের বলবো আপনার সন্তানের বাড়ি গাড়ি সম্পদ দেখলে তার উৎস নিয়ে প্রশ্ন করুন।
কথাগুলো বলছি, কারণ এই বাংলাদেশ সংকটটা যতোটা না অর্থনৈতিক তার চেয়েও বেশি মানবিক মূল্যবোধের। একদল লোক এখানে দুর্নীতি লুটপাট করে টাকা পাচার করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। আরেকদল মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করেও কোনমতে টিকে থাকতে পারছেন না।
ভয়াবহ এই দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা দরকার। এই দেশের প্রতিটা বড় বাড়ি, ফ্ল্যাট দামি গাড়ির মালিকের সম্পদের উৎস সন্ধান করা উচিত। কিন্তু এই রাষ্ট্র কখনো সেগুলো করবে না। কারণ এই দুর্বত্তরাই নানা নামে দেশ চালায়।
কাজেই রাষ্ট্র যতোদিন ব্যবস্থা নিচ্ছে না ততদিন আপনি অন্তত আপনার বাবার সম্পদ নিয়ে প্রশ্ন করুন। একইভাবে বাবারা সন্তানের অবৈধ সম্পদ নিয়ে প্রশ্ন তুলুন। আর সব বাবা-মায়েরা সন্তানদের মানবিক সৎ মানুষ বানানোর চেষ্টা করুন। সন্তানেরাও বাবা-মায়ের কাছে জবাবদিহিতা জানতে চান। কারণ সারাক্ষণ নিজের স্বার্থ ক্ষমতা পদ পদবী টাকা পয়সার কথা ভাবতে গিয়ে আমরা নিজেরা নষ্ট হচ্ছি, ধ্বংস করছি এই দেশ সমাজ। সৎ ও মানবিক মূল্যবোধ ছাড়া এই দেশ সমাজ সংস্কৃতি ঠিক করার কোন উপায় নেই।
আমার নিজের বাবার কথা বলি। তিনিও সরকারি চাকরি করতেন রোজার ঈদ বাদে আমাদের কখনো নতুন কাপড় দিতে পারতেন না। তিনি সবসময় বলতেন বাড়ি গাড়ি টাকা পয়সাসহ আশপাশে যা দেখো সেগুলো সত্যিকারের সম্পদ নয়, বরং সততা সম্মান মানবিক মূল্যবোধসহ যেগুলো দেখা যায় না সেগুলোই আসল সম্পদ। সারা জীবন অদেখা সেই সম্পর্ক অর্জন করার চেষ্টা করবে। কখনো হারাম পথে আয় করবে না। মানুষকে কষ্ট দেবে না।
সারা জীবন কথাগুলো মেনে চলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সত্যি বলছি আজকাল মাঝে মধ্যে ভীষণ রাগ হয়। এত কষ্ট করে আমরা বাঁচার চেষ্টা করি কিন্তু চারপাশের একদল দুর্বৃত্ত দুর্নীতি করে লুটপাট করে বিদেশে টাকা পাচার করে দেশটা বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারলে মানসিক শান্তি পেতাম।
ওপরওয়ালা আমাদের সবাইকে মানবিক বোধ দিন। সৎ ভাবে বাঁচা তৌফিক দিক। অন্তত আমরা যেন অসততাকে প্রশ্ন করতে পারি অন্তত নিজের বাবার বা সন্তানের। ভালো থাকুক সব বাবারা। ভালো থাকুক সব সন্তানরা। দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন লুটপাট বন্ধ হোক এ দেশে। ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ।
শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও কলামিস্ট